ভূমিহীনদের মাঝে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া উপহার ঘর হস্তান্তরের পর ভেঙে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নড়েচড়ে বসেছেন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, অতি উৎসাহী নবীন কর্মকর্তারা নীতিমালা না মেনে নিচু ও নরম জায়গায় ঘর নির্মাণ করায় কিছু ঘরে ফাটল ধরেছে।
আর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, শুরুর দিকে এ বিষয়ে নজর দিলে বর্তমানে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিলো এ দেশের মানুষের মধ্যে কেউ ঘরহীন থাকবে না। পিতার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাঁরই জন্মশতবার্ষিকীতে আশ্রয়হীনদের জন্য ঘরের পদক্ষেপ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেই দিক থেকে ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প-২’ প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প। প্রকল্পটিকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ভূমিহীন ও ঘরহীন মানুষের মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রায় সোয়া লাখ ভূমি ও ঘরহীন মানুষের মাঝে ঘরের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বিশ্বে নতুন নজির তৈরি করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ঘর বুঝে পাওয়ার কিছুদিন পরই কিছু ঘরের মেঝে, দেয়ালে ফাটল এবং বারান্দা ভেঙে যাওয়ায় ব্যাপকভাবে সমালোচনা হচ্ছে।
তবে প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, সামান্য ভুলত্রুটি শুধরে নিয়ে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবেন তাঁরা। এ সমস্যা সমাধানে গত ৮ জুলাই দেশের ১২ জেলার ২০ উপজেলায় প্রকল্পের ঘর পরিদর্শনে পাঁচটি পরিদর্শন কমিটি গঠন করে দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
এদিকে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দেশজুড়ে আরো প্রায় এক লাখ ঘর বুঝিয়ে দেওয়ার কার্যক্রমও চলছে।
দেশের প্রায় ৯ লাখ ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষকে ঘর দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। ‘মুজিব শতবর্ষে বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’ এই লক্ষ্য সামনে রেখে গত বছর থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। চলতি বছরের শেষ নাগাদ সব মিলিয়ে সোয়া দুই লাখ ঘর হস্তান্তরের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের।
সরকারের বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থার ভূমিহীন, গৃহহীনদের পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর বাইরে বেসরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ঘর করে দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
প্রকল্পটি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে তার নকশা হিসেবে ২০২০ সালে ‘মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য গৃহ প্রদান নীতিমালা’ প্রণয়ন করা হয়। নীতিমালার ৮(ঙ) অনুযায়ী, ‘অনুমোদিত নকশা ও প্রাক্কলন অনুযায়ী নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে হবে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি ঘর করার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। দ্বিতীয় পর্যায়ে সেটি উন্নীত করে এক লাখ ৯০ হাজার টাকা করা হয়। বর্তমানে তা করা হয়েছে দুই লাখ পাঁচ হাজার টাকা।
মাঠ পর্যায়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। সম্প্রতি বিভিন্ন এলাকায় এসব ঘর ধস ও ভেঙে যাওয়ার কর আসার পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। এমনকি এসব ঘটনায় কমপক্ষে ৫ জন ইউএনও কে ওএসডি করা হয়েছে।
তদন্তে নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় কোনো অনিয়ম দুর্নীতি হয়ে থাকলে জড়িতদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
তবে ইউএনওরা বলছেন, প্রকল্পের ঘর তৈরির জন্য যে উপাদান ব্যবহার করতে বলা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। ঘরের মেঝে ও পিলারে রডের ব্যবহার রাখা হয়নি। শুধু ইট, সিমেন্ট ও বালু দিয়ে ঘর তৈরি করলে সেই ঘরে ফাটল ধরবেই।
এসব ঘর উদ্বোধনের সময় খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ বেশ কিছু জেলার উপজেলায় কর্মরত ইউএনওদের নাম প্রকাশে কয়েকজন বলেন, প্রথমে ঘরের জন্য বালু ও সিমেন্টের মিশ্রণ অনুপাত রাখা হয়েছিল, তা-ও বাস্তবসম্মত ছিল না। হস্তান্তর করা ঘরগুলোতে ফাটল ধরার এটিও একটি কারণ। ঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ঘরের মেঝে ও দেয়াল নির্মাণের পর পানি দিয়ে ২১ থেকে ২৮ দিন ভিজিয়ে রাখার সময় পাওয়া যায়নি। আর নতুন জমিতে তাড়াহুড়া করে ঘর করতে হয়েছে।
খাসজমি দখলে নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে ইউএনওদের। তারা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ে তাদের উপজেলার অন্তত ৬০টি কমিটির সভাপতি হিসেবে বহুমুখী কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। দেড় বছর ধরে করোনা মহামারিতে লকডাউন বাস্তবায়ন, ত্রাণ কার্যক্রম এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নতুন কাজ যুক্ত হয়েছে। এসবের মধ্যেই দিন-রাত এক করে তারা আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ করেছেন।
পরিকল্পনায় দুর্বলতার কারণে এখন ঘরে ফাটল ধরার দায় নিতে হচ্ছে তাদের। এরই মধ্যে দুজন সাবেক ইউএনওর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। ইউএনও-এসি ল্যান্ড মিলিয়ে ওএসডি করা হয়েছে ছয় কর্মকর্তাকে। নকশা অনুযায়ী একটি মোটামুটি টেকসই ঘর করতে অন্তত আড়াই লাখ টাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন ইউএনও-রা।
সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দণ্ডপানিপুর গ্রামে প্রকল্পের ১৬টি ঘর দেওয়া হয়েছে গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারকে। শনিবার (১০ জুলাই) সকালে সেখানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ঘরে টুকটাক সমস্যা দেখা দিয়েছে। কোনো ঘরের মেঝেতে ফাটল দেখা দিয়েছে। কোনোটির রান্নাঘরের দেয়াল ফেটে গেছে। কোনোটির সাইড থেকে মাটি সরে গেছে। তবে স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে এ সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান করে দেওয়া হচ্ছে।
এখানকার উপকারভোগীদের একজন রহিমা খানম কালের আলোকে জানান, মাটি ঠিকমতো বসার আগেই ঘর তৈরি করায় এই সমস্যাটি হয়েছে।
একইদিন বিকেলে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার মাইজদীহিতে প্রকল্পের অনেক ঘর পরিদর্শন করে দেখা গেছে, এসব ঘরে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের উপ-পরিচালক জাহিদুর রহমান পরিদর্শনের সময় সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যে ধরনের পর্যবেক্ষণ আসছে, সেগুলোর বিষয়ে বিবেচনা করা হবে।’
এদিকে প্রকল্পটির নানামুখী দুর্বলতার কথা লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছিলেন কোনো কোনো উপজেলার ইউএনও-রা। কিন্তু তাদের সেসব কথা কানে তোলেননি জেলা প্রশাসন ও প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কিন্তু বর্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ইউএনওদের আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে।
‘ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণ প্রকল্পের বাস্তব চিত্র’ শীর্ষক একটি লিখিত প্রস্তাবে উত্তরবঙ্গের একটি উপজেলার একজন ইউএনওর পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে প্রকল্পের অনেক দুর্বলতা। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, মাটি ভরাটের টাকা প্রাক্কলনে ছিল না, ঘর দেখভাল করার জন্য ইউএনওদের যাতায়াত ভাড়া দেওয়া হলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির অন্য সদস্যদের দেওয়া হয় না, নতুন মাটিতে দ্রুত ঘর করা ঝুঁকিপূর্ণ, বস্তিতে খাসজমি পাওয়া কঠিন, যেসব বস্তিতে খাসজমি আছে সেখানে কেউ না কেউ বসবাস করছে। তাদের উচ্ছেদ করে ঘর করা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ, নিজস্ব লোকদের ঘর দিতে জনপ্রতিনিধিদের চাপ, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের রেকর্ডের জমির পাশে খাসজমি থাকলে সেখানে ঘর নির্মাণ করতে দিতে চায় না। খালি খাসজমি দখল করতে গেলে সেখানে রাতারাতি ঘর তুলে ক্ষতিপূরণের দাবি, অনেকে মামলার আশ্রয় নেওয়ায় আদালতের নির্দেশে কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে, প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়ে ঘর নির্মাণ করলে রাতে ঘর ভেঙে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে, ঘর তৈরির জন্য মালপত্র সরবরাহ করতে জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় নেতাকর্মীরা প্রতিযোগিতা করেন ইত্যাদি।
সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের এই প্রকল্পের ঘর দ্রুত তৈরি ও হস্তান্তরে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, মান ও তদারকির প্রতি ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এখন মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় পাঁচটি টিম মাঠে নেমে পরিদর্শন করছে।
মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, এত বড় একটি প্রকল্পের পাইলটিং করা হয়নি। জুনিয়র কর্মকর্তারা কোথায় কিভাবে ঘর তৈরি করছেন, সেটিও ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে ভালোভাবে দেখা হয়নি। প্রথম থেকে মনিটরিং থাকলে এই দোষত্রুটিগুলো ধরা পড়ত।
যোগাযোগ করা হলে প্রকল্প পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন বলছেন, ‘প্রায় সোয়া লাখ ঘরের মধ্যে যে কয়টি ভেঙে গেছে বা ফাটল ধরেছে, তা ০.২৫ শতাংশ। একটি প্রকল্পের জন্য এটি খুব বড় সমস্যা নয়। কিন্তু গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি ভিন্নভাবে দেখানোতে নেতিবাচক প্রচারিত হচ্ছে।
দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান হবে বলেও মনে করেন তিনি।