চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের একটি আস্তানা ঘিরে অভিযানে ব্যাপক গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের পর ভেতর থেকে দুইজনের ছিন্নভিন্ন লাশ উদ্ধারের কথা জানিয়েছে র্যাব। র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে ওই বাড়িতে অবস্থান নিয়ে নব্য জেএমবির জঙ্গিরা ‘চট্টগ্রাম আদালত ভবনে’ নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছে খবর পেয়ে তারা এ অভিযান চালান। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে প্রায় আট ঘণ্টার অভিযান শেষে জোরারগঞ্জ থানার উত্তর সোনাপাহাড় গ্রামে একতলা ওই টিনশেড বাড়ি থেকে একটি একে-২২ রাইফেল, পাঁচটি অবিস্ফোরিত আইইডি, তিনটি পিস্তল, গোলাবারুদ এবং বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে র্যাব। ‘চৌধুরী ম্যানশন’ নামে ওই বাড়ির মালিক ও কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে বলেও মুফতি মাহমুদ খান জানিয়েছেন। অভিযানে গোলাগুলির কারণে গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভোরের দিকে ওই বাড়িতে বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটনার পর গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। পরে নিয়ন্ত্রিতভাবে আবার যানবাহন চলাচল শুরু হয়। সকালে ঢাকা থেকে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা এসে বাড়ির ভেতরে ও বাইরে তল্লাশি চালিয়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার করে। তখনই দুইজন পুরুষের ছিন্নভিন্ন লাশ পাওয়া যায় বলে অভিযান শেষে এক ব্রিফিংয়ে জানান মুফতি মাহমুদ খান। বিএসআরএম স্টিল মিল ও বারইয়ার হাঁটের মাঝামাঝি এলাকায় মহাসড়কের পাশে ‘চৌধুরী ম্যানশন’ নামে ওই বাড়ির মালিক মাজহারুল হক চৌধুরী ঠিকাদারী ব্যবসা করেন, থাকেন পাশের এলাকায় এক বাড়িতে। সোহেল নামের এক লোক গত ২৯ সেপ্টেম্বর মাসে ৫ হাজার টাকা ভাড়ায় পাঁচ কক্ষের ওই বাসা ভাড়া নেন। তবে ভাড়া দেওয়ার সময় ভাড়াটিয়াদের জাতীয় পরিচয়পত্র রাখা হয়নি বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন বাড়ির মালিক ও কেয়ারটেকার। র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, এক নারী জঙ্গিসহ নব্য জেএমবির চার সদস্য ওই বাড়িতে উঠেছিল বলে তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। তবে বাড়িতে ওঠার পর ওই নারী সেখান থেকে চলে যান। মুফতি মাহমুদ খান ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, গত দুই মাসে বেশ কয়েকটি জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালিয়ে র্যাব জানতে পারে, ‘একটি গ্র“প’ চট্টগ্রাম ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছে এবং তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ আছে। তারা একটি ‘নাশকতার পরিকল্পনা’ করছে খবর পেয়ে গত বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে জোরারগঞ্জের ওই বাড়ি চিহ্নিত করে ঘিরে ফেলেন র্যাব সদস্যরা। তখন ভেতর থেকে জঙ্গিরা টের পেয়ে গুলিবর্ষণ করে। এবং বেশ কয়েকটি আইইডির বিস্ফোরণ ঘটায়। পরে বেশ কিছুক্ষণ গোলাগুলি চলতে থাকে। প্রায় ভোরের দিকেই বলা চলে, ভেতরে কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটে। ওই বিস্ফোরণে বাড়ির টিনের চাল উড়ে যায়। ঢাকা থেকে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে সকালে ওই বাড়ির আশপাশে তল্লাশি চালিয়ে দুটি আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) পান। পরে বাড়ির ভেতরে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া যায় আরও তিনটি আইইডি। বিস্ফোরকগুলো উদ্ধার করে বাড়ির পাশের খোলা জায়গায় নিয়ন্ত্রিতভাবে বিস্ফোরণ ঘটান তারা। জঙ্গিদের টার্গেট ছিল আদালত: চট্টগ্রামের আদালতে হামলার টার্গেট নিয়েই জঙ্গিরা মিরসরাই উপজেলায় মহাসড়কের পাশের জোরারগঞ্জের সোনাপাহাড় এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠেছিল বলে অভিযান শেষে জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। ‘আস্তানা’ থেকে যে রাইফেল উদ্ধার করা হয়েছে, একই ধরনের অস্ত্র ঢাকার হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়েছিল। অভিযান শেষে র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ ঘটনাস্থলে গণমাধ্যমকে বলেন, বাড়ির ভেতর থেকে দুই জঙ্গির ছিন্নভিন্ন লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁরা নিজেদের বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক, একটি একে ২২ রাইফেল, তিনটা পিস্তল, পাঁচটি গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযান সম্পর্কে মুফতি মাহমুদ বলেন, এ অঞ্চলে একটি জঙ্গিদল অস্ত্র নিয়ে সংগঠিত হচ্ছে, গোপন সংবাদে সেটা জানা যায়। তারা যে যার মাধ্যমে যোগযোগ রক্ষা করত, সেটি র্যাব চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। তার ভিত্তিতেই এ অভিযান চালানো হয়। রাত সাড়ে ৩টায় যখন অভিযান শুরু হয়, এর মধ্যে গোলাগুলি ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। রাত সাড়ে ৪টার দিকে বাড়ির মালিক ও তত্ত্বাবধায়ককে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করি। তাঁরা জানিয়েছেন, ২৮ সেপ্টেম্বরের দিকে সোহেল নামের এক ব্যক্তি এই বাড়ি ভাড়া নেয়। সে বলে, তার স্ত্রী, শাশুড়ি ও আরো একজন থাকবেন। সে আরো বলে, বিএসআরএমে চাকরি করে। মুফতি আরো বলেন, এখন থেকে যে একে ২২ রাইফেল উদ্ধার করা হয়েছে, এটি হলি আর্টিজানের হামলার সময় ব্যবহৃত হয়। আমাদের কাছে তথ্য ছিল, খুব তাড়াতাড়ি তারা চট্টগ্রামে নাশকতার পরিকল্পনা করছিল। কিছু ডকুমেন্টসও আমরা পেয়েছি যে, চট্টগ্রামের আদালতে তাদের একটা নাশকতা করার পরিকল্পনা ছিল। র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে উত্তর সোনাপাহাড় এলাকার একতলা টিনের বাড়িটি ঘিরে অভিযান শুরু হয়। বাড়িটির নাম ‘চৌধুরী ম্যানশন’। র্যাব প্রথমে মাইকে বাড়ির বাসিন্দাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। আধা ঘণ্টা পর বাড়িটির ভেতর থেকে র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। তখন র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ গোলাগুলি হয়। এর কিছুক্ষণ পর বেশ কয়েকটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে। বোমা বিস্ফোরণের কারণে ওই বাড়িটির টিনের চাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাড়ির দেয়ালে গুলির চিহ্ন রয়েছে। বাড়িটি ঘিরে রাখার পর র্যাব কিছুক্ষণের জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। গাড়িগুলো তখন বিকল্প পথে চলাচল করে। পরে অবশ্য মূল পথ খুলে দিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করা হয়।
সূত্রঃ দৃষ্টিপাত নেট।