স্বাধীনতাকামী বাঙালির হৃদয়ে বিজয়ের বৈজয়ন্তী উড়ানোর সোনাঝরা গৌরবের শেষ দিন। গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকার আন্তর্জাতিক নববর্ষ ২০২১ শুরুর আগের দিন। কুয়াশার হিমেল চাদর ছিন্ন করে নতুন সূর্যের হাতছানিতে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচনের আগ মুহুর্তকেই যেন বেছে নেওয়া হলো ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনার জন্য।
বাংলা ও বাঙালির স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজের স্বত:স্ফূর্ত আবেগ আর শ্রদ্ধাবনত চিত্তে নিজের জবানীতে তুলে আনলেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.বেনজীর আহমেদ, বিপিএম (বার)। বাঙালি ও বিশ্ববাসীর মানসপটে স্বমহিমায় উজ্জ্বল, চিরভাস্বর, মৃত্যুঞ্জয়ী ও শৃঙ্খলমুক্তির চির আরাধ্য পুরুষকে তিনি কখনও উচ্চারিত করলেন ইতিহাসের বজ্রকন্ঠের আলোকে, তারুণ্যের দীপ্তিতে, কর্মের চাঞ্চল্যে এবং স্বপ্নের অভিলাষে।
স্বপ্নবাজ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, আধুনিক, তেজোদীপ্ত ও কর্মঠ পুলিশ প্রধানের প্রায় ২৮ মিনিটের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেওয়ার চূড়ান্ত সংগ্রাম, পরাধীনতার গ্লানি থেকে নিজেদের মুক্ত করার সোপান, ঐতিহাসিক সেই ৭ মার্চে গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠের বাণী, বাঙালি জাতির ৪ হাজার বছরের দু:খ-বঞ্চনা- বাদ যায়নি কোন কিছুই।
নেতৃত্ব, দায়িত্ব ও অভিভাবকত্ব কাঁধে নিয়ে নিজের জাদুকরি শক্তিতে একটি দেশকে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব উপহার দেওয়া পিতা মুজিবকে নিয়ে গুটিকয়েক ব্যক্তির ঔদ্ধত্য প্রদর্শনকে কবির ভাষায় ড.বেনজীর বললেন, ‘সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি’। দেশপ্রেমকে সুসংহত করতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চর্চার গুরুত্বও উপস্থাপন করলেন সুনিপুণ দক্ষতায়।
স্বাধীনতার অভিযাত্রার মহান সোপান বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে রাজনীতির ‘ম্যাগনিফায়িং গ্লাস’ দিয়ে না দেখে দেশপ্রেমের ‘ম্যাগনিফায়িং গ্লাস’ দিয়ে দেখার আহ্বান জানালেন- ২০৪১ সালের উন্নত দেশের উপযোগী পুলিশ বাহিনী বিনির্মাণের প্রেরণা ও প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এ পুলিশের আইজি। কেবল মুখ:নিসৃত শব্দরাজি নয়, দেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে বজ্রবৃষ্টির মতো তীব্রভাবে যেন অভিঘাত করলো ক্যারিশম্যাটিক আইজিপির প্রাঞ্জল এই বক্তব্য।
বৃহস্পতিবার (৩১ ডিসেম্বর) রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত মহান বিজয় দিবস-২০২০ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা শীষর্ক আলোচনা সভা ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বই ‘দিশারী’র মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে পুলিশ মহাপরিদর্শকের মুখে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দই যেন অব্যর্থ ও পাকিপ্রেমে হাবুডুবু খাওয়া অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামী ও সাহসে দেশপ্রেমিক নিজ বাহিনীর সদস্যদের আত্নশক্তিতে বলীয়ান করে তোলার জন্য যথেষ্ট।
অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত পুলিশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ অতিরিক্ত আইজি থেকে শুরু করে সর্বকনিষ্ঠ কনস্টেবলরাও এক বাক্যে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নিয়ে পুলিশ প্রধান ড.বেনজীর আহমেদের প্রাজ্ঞ ও সুস্পষ্ট বক্তব্যের গুরুত্ব অপরিসীম ও বহুমাত্রিক তাৎপর্য বহন করে।
বিনির্মাণ করে একটি আদর্শিক স্বাতন্ত্র ধারা। তিনি ইতিহাসের ধারাপাতের মধ্যে দিয়ে নিজের সুচিন্তিত মতামতের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কেবল যুগের সৃষ্টি নয়। মহান জাতির পিতা ইতিহাসের পাললিক স্রষ্টাও’।
বাঙালির চার হাজার বছরের অস্তিত্বের ইতিহাস
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ নিজের দীর্ঘ বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে বাঙালির ৪ হাজার বছরের অস্তিত্বের ইতিহাস হিসেবেই উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ২৩ মিনিটের ভাষণ থেকে চার হাজার বছরের পটভূমি পাওয়া যায়। এই পটভূমি নির্দেশ করে, আমরা কিভাবে শুরু থেকে অতিক্রম করে জাতিসত্তা ও স্বাধীনতা অর্জন করেছি।’
ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যখন জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন আজ আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। তখন তিনি কিন্ত বাঙালি জাতির ৪ হাজার বছরের অস্তিত্ব হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন। তার এই দুঃখ ও ভারাক্রান্ত মন ছিল, ৪ হাজার বছরের বঞ্চনার দুঃখ, অপমানের দুঃখ, বৈষম্যের দুঃখ। যে বৈষম্য কারণে মানুষকে মনে করতে হয়েছে, শুধু দুধভাত হলেই তাদের জন্য যথেষ্ট।’
‘বাঙালি জাতি কখনো নিজেরা শাসন করেননি, শাসিত হয়েছেন’ মন্তব্য করে পুলিশ প্রধান বলেন, ‘চার হাজার বছরের ঘাত-প্রতিঘাতের পর নানা চড়াই উৎরাইয়ের ভেতর দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।’
দেশপ্রেম সুসংহত করতে বঙ্গবন্ধুকে চর্চা
আইজিপি আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এত উন্নতির পরও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু ব্যক্তি যা বলেন, তা শুনে একটি কবিতার লাইন মনে হয়, ‘সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি’। আমাদের বঙ্গবন্ধুর চর্চা করতে হবে দেশপ্রেম সুসংহত করার জন্য। আমরা যত বেশি বঙ্গবন্ধুকে চর্চা করবো ততবেশি আমরা দেশপ্রেমে সুসংহত হব।’
তিনি বলেন, ‘১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই ২৪ বছরে বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে দ্রুত গতিতে জাতিসত্ত্বার দিকে নিয়ে গেছেন, প্রেরণাদায়ক সংগ্রামের মুখোমুখি করেছেন এবং আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে রাজনীতির ‘ম্যাগনিফায়িং গ্লাস’ দিয়ে না দেখে দেশপ্রেমের ‘ম্যাগনিফায়িং গ্লাস’ দিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়ে আইজিপি বলেন, ‘৭ মার্চের সেই অমর ভাষণ আরো পরিব্যাপ্ত গবেষণার দাবী রাখে’।
শেক্সপিয়ার আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে জন্ম গ্রহণ করার পূর্বেও লাখ লাখ পিএইচডি হচ্ছে তাঁর ওপর। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ওপর হাজার হাজার পিএইচডি হতে পারে, যোগ করেন ড.আহমেদ।
বর্তমান প্রজন্ম দারিদ্র্যের ভয়াবহ রূপ, অশিক্ষার কুৎসিত রূপ দেখেনি। এখানে রোগের যে ভয়াবহ আক্রমণ ছিল তা তরুণ-তরুণীরাই দেখেনি বলেও মন্তব্য করেন পুলিশের আইজি। তিনি বলেন, ‘৪০ বছর থেকে বাংলাদেশের এখন গড় আয়ু ৭২ বছর। আশেপাশের সমস্ত দেশ, নিউক্লিয়ার পাওয়ার আছে এমন দেশকেও আমরা অতিক্রম করেছি। গত ১০ বছরে বাংলাদেশ কোথায় থেকে কোথায় এসেছে এটা এই জেনারেশন বুঝবে না। আন ইমাজিনেবল। এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে সেকারণে।’
ড.বেনজীর আহমেদ আরও বলেন, ‘১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তানের কথা বলা নেই। সেখানে বলা হয়েছে এক বা একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে। সেটা ভারতের উত্তরপূর্ব স্টেটসহকারে বলা হয়েছিল। পরবর্তীতে এটা হয়নি। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলো, তিনি অসমাপ্ত আত্নজীবনীতেও বলেছেন, এতে আমাদের কোন উন্নতি হবে না। আমাদের দেশের মানুষ টাইফয়েডে ভুগেছে। দারিদ্র্যকে মেনে নিয়েছে ভাগ্যের বিষয় হবে। ঘরে ঘরে তখন দারিদ্র্য। দুধে-ভাতের গল্প কেন আসে? কারণ ভয়াবহ দারিদ্র্য। এক মুঠো ভাত আরেকটু গরুর দুধ পেলেই তখন তারা মনে করছে কতো আশীর্বাদ।’
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে মহান জাতির পিতাকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার সঙ্গেই স্মরণ করেন পুলিশ মহাপরিদর্শক। প্রধানমন্ত্রীর সুদক্ষ ও গতিশীল নেতৃত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রাজ্ঞ জনোচিত নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের অর্থনৈতিক ও সামজিক ক্ষেত্রে সামনের দিকে ধাবমান করছেন। তার সঙ্গে যুক্ত হতে হবে কঠোর কঠিন দেশপ্রেম। দেশপ্রেমকে আমাদের ইস্পাত কঠিন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে বেশি করে চর্চা করতে হবে। আমাদের অগ্রযাত্রায় বঙ্গবন্ধুর অবদান, দেশপ্রেম ও চেতনাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণে ও বিশ্বাসে রেখে আমরা এগিয়ে যাবো এই প্রত্যাশা।
ইতিহাসের প্রয়োজনেই স্বাধীনতা বিরোধীরা বিলুপ্ত হবে
রাজাকার, স্বাধীনতা বিরোধীদের গ্রুপটির একটি অংশ পাকিস্তানীদের মোসাহেবী করে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন ড.বেনজীর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সেই অর্থবিত্ত তারা ৭১’র পরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে ব্যয় করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে যারা বেনিফিশিয়ারি হয়েছেন, সেই বেনিফিশিয়ারি গ্রুপকেও রাজনৈতিকভাবে এখানে প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের অর্থই ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই অর্থ দিয়ে আমরা এখনও দেখি দেশ-বিদেশ থেকে বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা।
কারণ ওই ২৪ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর দালালি করে অর্থবিত্ত যারা কামাই করেছিলেন সেই অর্থবিত্ত ও প্রভাব তাদের এখনও রয়েছে। এজন্য হতাশার কোন কারণ নেই। সময়ের পরিক্রমায়, সময়ের দাবিতে ইতিহাসের প্রয়োজনে এরা একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে সম্পূর্ণভাবে। বাঙালি জাতি নিষ্কলঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের পর প্রজন্মের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা এগুলোকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আত্নমর্যাদাশীল দেশের নাগরিক নিশ্চয়ই আমরা অর্জন করবো। ২০৪১ সালের ধনী ও উন্নত দেশের মানুষ হবে আমাদের দেশের পরবর্তী প্রজন্ম-এমন আশার কথাও উচ্চারণ করেন পুলিশের ৩০ তম আইজি।
অন্য অতিথিরা কে কী বললেন?
এ অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে সভায় অন্যদের মাঝে অতিরিক্ত আইজি ড. মইনুর রহমান চৌধুরী, এসবির অতিরিক্ত আইজি মীর শহীদুল ইসলাম, পুলিশ স্টাফ কলেজের রেক্টর ড. মোহাম্মদ নাজিবুর রহমানসহ ঢাকার পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রধান, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা এবং পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, ‘বাঙালি কখনো স্বাধীন ছিল না। বাংলাদেশকে যিনি স্বাধীন করেছেন তিনি বঙ্গবন্ধু। তাঁকে নিয়ে কোন দ্বিধা নেই, সংশয় নেই। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আমরা যদি পিতাকে অস্বীকার করি তাহলে আমরা কিভাবে এ দেশে বাস করি। আমরা তাকে হৃদয়ে রাখবো, সকলের মাঝে তাঁঁর চেতনাকে ছড়িয়ে দিবো।’
সভাপতির বক্তব্যে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসলে আমরা দেশকে ভালবাসতে পারবো, দেশের জনগণকে ভালবাসতে পারবো।’
- আবদুল্লাহ আল মামুন খান,এডিটর, কালের আলো।