১৯৮৯ সাল। বাংলাদেশ পুলিশে যোগ হয় আরেকটি নতুন অধ্যায়। দেশের সীমানা পেরিয়ে, দেশের পতাকাকে বুকে ধারণ করে বাংলাদেশ পুলিশ প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেয়।
আফ্রিকার দেশ নামিবিয়ায় ইউনাইটেড নেশনস ট্রানজিশন অ্যাসিট্যান্ট গ্রুপ (ইউএনটিএজি) মিশন দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের বিশ্ব শান্তি যাত্রার শুরু। এরপর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের ১৮ হাজার ১০০ জন সদস্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করেছেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সংঘাত ও যুদ্ধবিধবস্ত ২২ টি শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশ দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে মিশন পরিচালনা করেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী প্রেরণের দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশের অবস্থান চতুর্থ। এ গৌরব শুধু বাংলাদেশ পুলিশের নয়, এ গৌরব পুরো বাংলাদেশের।
সময়ের সাথে দক্ষ হয়ে ওঠা বাংলাদেশ পুলিশ বিশ্ব শান্তির অগ্রযাত্রায় ২০০৫ সালে যোগ করে নতুন এক মাত্রা। আইভরিকোস্টে প্রথমবারের মতো পাঠানো হয় বিশেষভাবে সজ্জিত ফরমড পুলিশ ইউনিট (এফপিইউ)। তারপর থেকে বাংলাদেশী এফপিইউ এবং ইউএনপোলসমূহ সুখ্যাতির সাথে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন মিশনে কাজ করে চলছে। বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের ৪৩ জন কর্মকর্তা ইন্ডিভিজুয়্যাল পুলিশ অফিসার (আইপিও) হিসেবে ০৪ টি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে এবং ০৫ জন পুলিশ কর্মকর্তা জাতিসংঘে পি-লেভেলে কর্মরত আছেন। সর্বমোট বাংলাদেশ পুলিশের ৭৮৩ জন কর্মকর্তা বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত আছেন।
সময়ের সাথে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় দক্ষ হয়ে ওঠা বাংলাদেশ পুলিশ ফরেনসিক, ফুট প্রিন্ট, ফিঙ্গার প্রিন্ট, ব্যালিস্টিক, ডেমোক্র্যাটিক পুলিশিং, কমিউনিটি পুলিশিং প্রভৃতি বিষয়গুলোতেও দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে চলছে। শান্তিরক্ষা মিশনগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশ পুলিশ জাতিসংঘের সদর দপ্তরের বিভিন্ন বিভাগে অধিষ্ঠিত থেকে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে চলছে।
প্রতিটি মিশনে বাংলাদেশ পুলিশ সর্বোচ্চ আন্তরিকতা, পেশাদারিত্ব ও উৎসর্জন নিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়াও নিরস্ত্রীকরণ ও পুনঃএকত্রিকরণ প্রক্রিয়া, আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, বিতাড়িত ও নিপীড়িত মানুষের সুরক্ষা প্রদান, মানবিক সহায়তা সহজতরকরণ ও মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ পুলিশ সহায়তা করে চলছে।
নারী ও শিশুর জন্য জাতিসংঘের জেন্ডার ইস্যু ম্যান্ডেট বাস্তবায়নে সহায়তা করতে বাংলাদেশ পুলিশ কঙ্গোতে প্রথমবারের মতো নারী এফপিইউ প্রেরণ করে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নারী পুলিশ শান্তিরক্ষী প্রেরণে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে। এ সকল নারী পুলিশ শান্তিরক্ষীগণ যুদ্ধ থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠেছেন।
বাংলাদেশ পুলিশের নারী শান্তিরক্ষীগন লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষকে হ্রাস করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এছাড়াও বাংলাদেশ নারী পুলিশ শান্তিরক্ষীগণ মিশন দেশগুলোতে নারী ও শিশুদের জন্য নিরাপত্তা প্রদান, স্থানীয় নারী পুলিশ কর্মকর্তাদের পরামর্শ প্রদান এবং মিশন দেশগুলোতে নারীর ক্ষমতায়নে অবদান রেখে চলছেন। তাদের কর্মকাণ্ড ও সুখ্যাতি দিয়ে মিশন এলাকাগুলোতে বাংলাদেশ নারী পুলিশ শান্তিরক্ষীগণ নিজেদের মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ফলস্বরূপ, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ নারী পুলিশ শান্তিরক্ষীদের চাহিদা বাড়ছে।
এসব শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের ২০ জন শান্তিরক্ষী তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবসে আত্মদানকারী সে সকল পুলিশ সদস্যদের প্রতি বাংলাদেশ পুলিশ জানাচ্ছে বিনম্র শ্রদ্ধা।
প্রিয় সহকর্মীদেরকে হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে বাংলাদেশ পুলিশ তার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলছে। শুধু দেশেই নয়, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব জুড়ে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ পুলিশ আরও দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যাবে- আজকের আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবসে এটিই বাংলাদেশ পুলিশের অঙ্গীকার।