রমজান আহমেদ। ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠেছেন বেদেপল্লীতে। পূর্বপুরুষের জায়গা-জমি না থাকায় থাকতেন নৌকায় নৌকায়। বাস সাভারের বেদেপল্লীতে। পল্লীর সবার মতো তার (রমজান) পরিবার সাপ খেলা দেখানো, তাবিজ বিক্রি করে চলত। সেই মানুষটির জীবন পাল্টে গেছে পুরোপুরি। এখন তিনি বেদেদের জীবনমান কীভাবে উন্নয়ন করা যায় সে কাজে নিয়োজিত।
পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীতে সমাজের মূলধারায় উঠিয়ে আনতে কাজ করছে উত্তরণ ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন, যেটাতে কাজ করেন রমজান। আর এই উদ্যোগটা এসেছে যার হাত ধরে তিনি একজন পুলিশ কর্মকর্তা। আছেন ঢাকা রেঞ্জের , উপমহাপরিদর্শক বা ডিআইজি পদে। নাম হাবিবুর রহমান।
২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সাভার থেকে শুরু হয় উত্তরণ ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম। বর্তমানে সাভার ছাড়াও মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও সিংড়া এলাকার বেদে ও হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে কাজ করছে উত্তরণ।
রমজান আহমেদ এই প্রকল্পে যুক্ত হন ২০১৫ সালে। তিনি ফাউন্ডেশনে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন সাভার প্রকল্পের পরিচালক। নিজেও ব্যক্তিগতভাবে গড়েছেন চাইনিজ রেস্টুরেন্ট।
সাজেনুর বেগম। বাবার সঙ্গে সাপ খেলা আর তাবিজ বিক্রি করে সংসার চালাতেন। এখন তিনি উত্তরণ প্রকল্পের অধীনে একটি পোশাক কারখানায় স্টোরকিপার হিসেবে কাজ করেন।
সাজেনুরের তিন ছেলেমেয়ের সবাই এখন পড়ালেখা করছে। বড় ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। মেজো ছেলে সপ্তম শ্রেণি এবং ছোট মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
সাজেনুর বলেন, ‘২০১৪ সালে আমি ট্রেনিং নিয়েছি। আগের জীবনে অনেক কষ্ট ছিল, সম্মান ছিল না। এখন আমি যতটা আয় করি, তার চেয়ে বেশি অর্জন করেছি সম্মান। আমার সন্তানরা এখন স্বপ্ন দেখে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো বড় হবে। অথচ আগে আমাদের মানুষ বাঁকা চোখে দেখত। আমরাও নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিলাম। আমাদের সন্তানরাও ছিল এমন।’
এই দুইজনের মতো অনেকে ভাসমান জীবন ছেড়ে এখন প্রতিষ্ঠিত। আর তাদের সবাই এখন উত্তরণ ফাউন্ডেশনের কাছে কৃতজ্ঞ।
সমাজের সুবিধাবঞ্চিত বেদে ও হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে কাজ করছে এই ফাউন্ডেশন। এখানে নারীদের সেলাই, বিউটি পার্লারের কাজসহ নানা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আর পুরুষরা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। সাভারে গড়ে উঠেছে উত্তরণ ফাউন্ডেশনের ফ্যাক্টরি। যেখানে গরুর খামার গড়ে তোলা হয়েছে। আছে পোশাক কারখানা যেখানে তৈরি হয় প্যান্ট, গেঞ্জি, টি-শার্ট। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকে বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন।
উত্তরণ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ডিআইজি (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান বলছিলেন কীভাবে এবং কেন তিনি এই কাজে হাত দিয়েছেন। জানালেন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, হিজড়াদের জন্য একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র করার স্বপ্নের কথা।
হাবিবুর রহমান জানান, তিনি যখন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন তখন সাভারে বেদেপল্লীর বাসিন্দাদের মধ্যে তীব্র বেকারত্ব, মাদকের আসক্তি আর আয়ের জন্য যৌনকর্মে লিপ্ত হতে দেখে ভাবেন, এই পরিস্থিতি পাল্টাতে হবে।
‘একজন নাগরিক হিসেবে মনে হয়েছে এরা সমাজে অবহেলিত। পুলিশ হিসেবেও তো আমার দায়িত্ব আছে। এই কারণে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমি আইন প্রয়োগ না করে তাদের সচেতন করি। যাতে তারা খারাপ কাজ না করে নিজেদের সৎভাবে গড়ে তুলতে পারে।’
‘আমরা নানা সময় আইনবিরোধী কাজে লিপ্তদের আটক করেছি। কিন্তু এতে সমস্যার সমাধান হচ্ছিল না। কারণ, মুক্তি পেয়ে তারা আবার একই কাজ করত। তাদের সামনে বিকল্পও ছিল না। তাই ভাবলাম, তাদেরকে এই পথ থেকে সরিয়ে আনতে বিকল্পের সন্ধান দিতে হবে।’
‘ভেবে দেখলাম, বাঁচতে হবে বলে তারা হাত পাতছে। কারণ তাদের তো মানুষের কাছ থেকে চেয়ে খাওয়া ছাড়া উপায় নেই। স্বল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত হলেও তাদের কেউ কাজ দিচ্ছে না। কাজ দিলেও বেতন নগণ্য, যা দিয়ে চলা কষ্টকর। তাই তাদের জন্য আয়ের সুযোগ করে দিতে হবে।’
পুলিশ দুইভাবে অপরাধপ্রবণতা রোখার চেষ্টা করে। এক. আইনের কঠোর প্রয়োগ; দুই. কাউন্সেলিং করে কাজ ও আয়ের সুযোগ তৈরি করে মানুষকে সাধারণ জীবনযাপনে উৎসাহী করা।
মনোভাবের পরিবর্তন এখন বেদেদের সাধারণ জীবনযাপনে তাড়িত করেছে, সেটাও জানান হাবিবুর রহমান। বলেন, ‘আমি আস্তে আস্তে ওদের মনের অবস্থার পরিবর্তন করেছি। তারা ভাবতে শিখেছে একজন এসপির যে দাম তাদেরও সেই দাম। ওরা আমার বাসায় গিয়ে সোফায় বসতে পারে। আমি তাদের সঙ্গে নিয়ে একই টেবিলে খাবার খাই। বুঝতে শিখেছে তারা এত নীচু না বা ছোট না।’
উত্তরণ ফাউন্ডেশন এখন সাভার ও মুন্সিগঞ্জে দুটি স্কুল ও কম্পিউটার সেন্টার চালায়। সেখানে শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্করাও পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে আয়বর্ধক কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছে। এখন পরিকল্পনা আছে বগুড়াতে এমন একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করার।
প্রথম টাকাটা হাবিবুর রহমান নিজেই দিয়েছিলেন। এরপর এখান থেকে আয়েই নতুন নতুন ব্যবসা চালু হয়েছে। বিউটি পার্লার, গরুর খামার আর ছোটখাটো একটি পোশাক কারখানা থেকে যে আয় আসে তাতে বাইরে থেকে আর আর্থিক সহায়তা নেওয়ার দরকারও পড়ে না।
এখন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য নতুন পরিকল্পনা করছেন হাবিবুর রহমান। বলেন, ‘অষ্টম বা নবম শ্রেণিতে পড়াশোনার সময় একজন মানুষ বুঝতে পারে সে হিজড়া। তার আগে কেউ টের পায় না। এ সময় সে আর স্কুলে বা কলেজেও যেতে পারে না। এই পর্যায়ের মানুষের জন্য একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে চাই। যারা তাদের সমস্যাটা প্রকাশ করবে তাদের কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। যেখানে কাজ শিখে সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। কারণ হিজড়াদের নিজস্ব থাকার কোনো জায়গা নেই।’
হিজড়া বা বেদে সম্প্রদায়ের মানুষদের পুনর্বাসনের পর রাস্তায় টাকা তোলার প্রবণতা কমবে বলেও মনে করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। বলেন, ‘আমাদের সমাজ তাদের অপাঙক্তেয় করেছে। এভাবে সমস্যার সমাধান হবে না। তাদেরকে কেন আলাদা করে দেখব আমরা। তারাও মানুষ। তাদেরকেও মানসম্মত জীবনযাপনের সুযোগ করে দিতে হবে।’
হাবিবুর রহমান ১৯৬৭ সালে গোপালগঞ্জের চন্দ্র দিঘলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৭তম বিসিএসে তিনি সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে যোগ দেন। কর্মক্ষেত্রে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার জন্য তিনবার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) ও দুইবার রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পেয়েছেন। পেশাগত কাজের বাইরে তিনি একজন ক্রীড়া সংগঠক। বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন সেক্রেটারি এবং এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশনের সহসভাপতি এই পুলিশ কর্মকর্তা।