♣♣♣♣
হাডুডু খেলিয়ে/বাঘ মারে ঢেলিয়ে/বাঘের তলে প্রদীপ জ্বলে/জ্বলছে প্রদীপ উঠছে ধোঁয়া/ডাকতে আয়রে ছুঁচো মুয়া’—এটা নিছক ছড়া নয়। গ্রামবাংলায় কাবাডি খেলার এ ধরনের নানা বোল নানা অঞ্চলে প্রচলিত ছিল।
যে বোলটি এখানে উল্লেখ করলাম সেটি ঢাকা অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। এটি আবার এই খেলার উৎপত্তি সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়। কাবাডির উৎপত্তি ও উৎপত্তিস্থল নিয়ে নানা ধরনের মত আছে। তবে এটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে যে প্রাচীনকালে বন্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার কৌশল থেকেই কাবাডি খেলার সূচনা। কেউ বলে বাংলাদেশের ফরিদপুরে প্রথম কাবাডির উৎপত্তি, কেউ বলে পাঞ্জাব, কেউ বলে ভারতের তামিলনাড়ু থেকে খেলাটি বিস্তৃত হয়।
কাবাডি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে তামিল কাই ও পিডি শব্দ দুটির সম্মিলনে। এদের অর্থ যথাক্রমে হাত ও ধারা। অনেকে বলে, কাবাডি শব্দটি পাঞ্জাব ‘কুড্ডি’ থেকে উৎপন্ন, আবার কেউ বলে পাঞ্জাবি শব্দ ‘কাট্টা’ (হাঁটু) ও ‘ভাড্ডি’ (কাউকে আটকানোর চেষ্টা) শব্দ থেকে কাবাডি শব্দটি প্রথম প্রচলিত হয়। আমাদের দেশে খেলাটি হাডুডু নামে পরিচিত ছিল, যার মূল শব্দ হিসেবে অনেকে ‘হাঁটু’কে উল্লেখ করে।
অঞ্চলভেদে এর বিভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন রাজশাহীতে ‘কপাটি’, ময়মনসিংহে ‘চিঞ্চরানী’, রংপুরে ‘টিকটিক’। বলা যায়, চার হাজার বছরের পুরনো খেলাটির উৎপত্তি সুনির্দিষ্টভাবে যেখানেই হোক না কেন, এটি এ অঞ্চলের বা দক্ষিণ এশিয়ার খেলা।
কৃষ্ণের ভাইপো অভিমান্যু ছিলেন একজন সাহসী যোদ্ধা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি কৌরব সেনাদের চক্রব্যূহের মধ্যে আটকা পড়েন। তখন তিনি এক অভিনব যুদ্ধকৌশল ব্যবহার করেন, যা পরবর্তী সময়ে কাবাডি খেলায় রূপান্তরের মাধ্যমে চর্চিত হতে থাকে বলে মহাভারতে বর্ণিত আছে। গৌতম বুদ্ধ তাঁর ধ্যানচর্চার অংশ হিসেবে কাবাডি খেলতেন বলে অনেক ইতিহাসবিদের অভিমত।
সুস্থ দেহ, সুস্থ মনের জন্য কাবাডিচর্চার বিকল্প নেই। অন্যভাবে বলা যায়, ‘দম নেওয়া’ বা ‘ফুসফুসের শক্তি বৃদ্ধি করা’, ক্ষিপ্রতা, সহনশীলতা, দ্রুত চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, প্রতিপক্ষের কৌশল ও মনোভাব অনুধাবন করার ক্ষমতা প্রভৃতি কাবাডি খেলায় যেভাবে চর্চা করা হয়, অন্যটিতে তা হয় না।
১৯২৩ সালে নারায়ণ চন্দ্র নামের এক সমাজকর্মী ফরিদপুরে গঠন করেন ছাত্রসংঘ। তিনি ও তাঁর যুবক সহমতাবলম্বীরা হাডুডু চর্চা করতেন এবং বৃহত্তর ফরিদপুর থেকে তা ছড়িয়ে দেন বিভিন্ন অঞ্চলে। এটি শুধু খেলা ছিল না—ছিল আত্মগৌরব ও সঞ্জীবনী শক্তির এক প্রদর্শনী, ছিল গণমানুষের অন্তর্গত শক্তিকে প্রস্ফুটিত করে সম্মিলিত শক্তিতে রূপান্তরের এক অভিনব উপায়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সেই আমলের শোষক ইংরেজদের কর্মকাণ্ডে। ১৯৩০ সালে তারা নিষিদ্ধ করে কাবাডিকে। একে ঘিরে গড়ে ওঠে এক জাতীয়তাবাদী চেতনা। প্রতিবাদ আর বিক্ষোভ কলকাতা-দিল্লি-ঢাকা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৩১ সালে ইংরেজরা বাধ্য হয় নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে।
ভারত ও পাকিস্তানে খেলাটি কাবাডি নামে পরিচিত। নেপালে এই খেলাকে বলা হয় ডু ডু, শ্রীলঙ্কায় গুডু গুডু, থাইল্যান্ডে থিকার, মালয়েশিয়ায় ছি গুডু গুডু। আমাদের দেশে খেলাটি পরিচিত ও জনপ্রিয় ছিল হাডুডু নামে। খেলার উপকরণ হিসেবে মানুষ আর এক টুকরা জমি ছাড়া আর কিছুই লাগে না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খেলাটিকে ‘জাতীয় খেলা’র মর্যাদা দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে হাডুডু খেলাটির নামকরণ হয় কাবাডি। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন গঠিত হয়।
ঐক্যবদ্ধ নিয়মে খেলাটি প্রচলনের জন্য ১৯৫০ সালে ভারতে জাতীয় কাবাডি ফেডারেশন গঠিত হয়। ১৯৫৩ সালে এই ফেডারেশন কাবাডি খেলার নিয়ম-কানুন প্রণয়ন করে। ১৯৬০ সালে কিছু নিয়ম-কানুন সংশোধন ও সংযোজন হয়। ১৯৭৪ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম কাবাডি টেস্ট বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় কাবাডি দল পাঁচটি টেস্টে অংশগ্রহণ করে ৪-১ এ জয়লাভ করে। এ প্রতিযোগিতা বাংলাদেশে বিপুল উৎসাহের সৃষ্টি করে। ফিরতি টেস্ট খেলার জন্য বাংলাদেশের জাতীয় কাবাডি দল ১৯৭৯ সালে ভারতে যায়।
১৯৮৭ সালে ভারতের মধ্য প্রদেশের ভিলাই স্টিল মিলের গেস্টহাউসে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের প্রতিনিধিরা যোগদান করেন। ওই বৈঠকে এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশন গঠিত হয়। ১৯৮০ সালে প্রথম এশিয়ান কাবাডি চ্যাম্পিয়নশিপ কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল অংশগ্রহণ করে। ভারত চ্যাম্পিয়ন ও বাংলাদেশ রানার্স-আপ হয়।
১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশে জাতীয় কাবাডি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যদি বাংলাদেশের কাবাডির ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো যায়, তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে আফসোস করতেই হয়। একটা সময় এশিয়ান গেমস থেকে বলেকয়ে পদক নিয়ে দেশে ফিরত বাংলাদেশ কাবাডি দল; কিন্তু এশিয়ান গেমসের গত দুই আসর থেকে কোনো পদক জোটেনি বাংলাদেশের। ১৯৯০ ও ১৯৯৪ সালে এশিয়ান গেমসে টানা দুটি রুপা জেতে বাংলাদেশ। এরপর ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ সাফ গেমসেও আসে রুপা। ২০০২ সালের এশিয়ান গেমসে কাবাডিতে বাংলাদেশ সর্বশেষ রুপা জেতে। এশিয়ান গেমসে কাবাডিতে বাংলাদেশের সব শেষ পদক ব্রোঞ্জ আসে ২০০৬ সালে। এরপর আরো দুটি আসর হয়ে গেলেও বলার মতো কোনো অর্জন ছিল না বাংলাদেশের।
বাংলাদেশ কাবাডি দল স্বর্ণালি সময় পার করেছে। কাবাডির ইতিহাস বর্ণনা করা আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়। খেলাটি যে আমাদের সংস্কৃতির, আমাদের গৌরবের, তা পুনর্ব্যক্ত করাই উদ্দেশ্য। সম্প্রতি ঢাকায় আমরা সফলভাবে শেষ করলাম বসুন্ধরা স্বাধীনতা কাপ কাবাডি ২০১৭। বিপুল দর্শক, গণমাধ্যমের সাড়া আর বিদগ্ধজনদের উৎসাহ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে সামনে এগিয়ে যেতে, হারিয়ে যাওয়া কাবাডিকে আবার আমাদের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে।
আমাদের দেশে এখন সার্ভিস দল (যেমন—বিজিবি, সেনাবাহিনী, পুলিশ, নৌবাহিনী প্রভৃতি) ছাড়া জাতীয় কাবাডি দলে একজন খেলোয়াড়ও নেই। এর কারণ হলো খেলাটিতে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। যারা আয়োজক বা সমন্বয়ক (কাবাডি ফেডারেশন) হিসেবে কাজ করেছি বা করছি, তারাও দায় এড়িয়ে যাচ্ছি না। দায়মুক্তির জন্য বলছি, আসুন, খেলাটির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা, আন্তর্জাতিক বিস্তৃতি ও এর সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমাদের ইরাদ (ক্যাপ্টেন নামে যিনি সুপরিচিত) বিশ্বকাপে মাত্র পাঁচটি ম্যাচ খেলে সর্বোচ্চ রেড পয়েন্ট পেয়ে আমাদের সক্ষমতাকে প্রমাণ করেছেন। পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে এমন অনেক ক্যাপ্টেনের জন্ম হবে। আমরা চাই, ক্রিকেটের সাফল্য ধরে রেখে কাবাডিকেও একটি সফল খেলা হিসেবে দাঁড় করাতে।
লেখক :জনাব মোঃ হাবিবুর রহমান,(বিপিএম) বার (পিপিএম),ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল,পুলিশ হেডকোয়াটার্স ও
সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় কাবাডি ফেডারেশন।
সূত্রঃকালের কন্ঠ ডটকম।