খুলনার একেবারে পাশেরই একটি উপজেলা বটিয়াঘাটা। এ উপজেলার নির্বাহী অফিসার দেবাশীষ চৌধুরী। পিতা ছিলেন শিক্ষক। ছাত্রদের পড়ানোর সময় তিনি যখন শাসন করতেন তখন ছিলেন অত্যন্ত কড়া মেজাজের। কিন্তু কেউ যখন তার কাছে আসতেন তিনি বলতেন, ‘সকল দরজা বন্ধ হলেও ক্ষমার দুয়ার খোলা’।
কর্মজীবনে এসে তিনি দেখলেন মানুষের সেবার মধ্যদিয়েই আনন্দ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেবার মাধ্যমে যে আনন্দ পাওয়া যায় সেটি সেবা গ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারী উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সেই সাথে সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদও নিশ্চিত হবে। তাইতো তিনি বটিয়াঘাটায় চালু করতে যাচ্ছেন ব্যতিক্রমী উদ্ভাবন ‘সেবানন্দ’। তার প্রধান শ্লোগান হচ্ছে, ‘সকল দরজা বন্ধ হলেও সেবার দুয়ার খোলা’।
সেবা পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কি আনন্দ সেটি দেখা যায় মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার গঙ্গারামপুর ইউনিয়নের তিতুখালী গ্রামের অসুস্থ মহানন্দ বিশ্বাসের মধ্যে। নিজে হাঁটতে পারেন না, তার পরেও হাতের লাঠিটা রেখেই জড়িয়ে ধরতে চাইছিলেন ইউএনওকে। ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ-ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ এ শ্লোগান বাস্তবায়নের চেষ্টা চললেও বটিয়াঘাটার ওই বাড়িটি এতোদিন বিদ্যুৎ বঞ্চিত থাকার ফলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর শ্লোগান বাস্তবায়নেও অন্তরায় দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত জেলা প্রশাসকের নির্দেশে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিষয়টির ত্বড়িৎ ব্যবস্থা নেয়ায় স্বস্তি ফেরে ওই পরিবারে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে কথা হয় মহানন্দ বিশ্বাস ও তার ছেলে দেবব্রত বিশ্বাসের সাথে। খুশিতে কথা বলতে পারছিলেন না মহানন্দ। তিনি নিজেও অসুস্থ। টিনসেড আর মাটির দেয়ালের ঘরটিতে কোন ফ্যানও নেই। একটু আলোর জন্য দেড় বছর আগে থেকে ঝুলছে বাল্ব ও সুইচ। কিন্তু বাতি জ্বলছে না। হঠাৎ সেদিন ঘরে আলো দেখেই চোখে পানি চলে আসে অসুস্থ মহানন্দের। ভ্যানচালক দেবব্রত বিশ্বাস দৌড়ে এসে বললেন, ফ্যান কেনার সামর্থ্য নেই, তার পরেও অসুস্থ পিতার জন্য দেখি একটা ফ্যানের ব্যবস্থা করা যায় কি না। এসময় ইউএনও তাকে একটা ফ্যান দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন। এতে ওই পরিবারের সবাইই শুধু নয়, স্থানীয় জনসাধারণও কৃতজ্ঞতা জানান।
সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কক্ষের সামনে কথা হয় সত্তরোর্ধ এক নারীর সাথে। তিনি এসেছেন আর্থিক সহযোগিতার জন্য। ইউএনও তো জনপ্রতিনিধি নন, তিনি কিভাবে আর্থিক সহযোগীতা দেবেন প্রশ্ন করা হলে অবাক কন্ঠে তাকিয়ে ওই নারী এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘উনি পারবেন বলেই এসেছি’। জমিজমা সংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়েও হাজির হয়েছিলেন অনেকে। সবারই ধারণা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে গেলেই কিছু একটা সমাধান মিলবে।
কয়েকমাস আগে উপজেলা প্রশাসনের চেষ্টায় প্রতিবন্ধী তুষার কান্তি রায়ের পৈত্রিক ভিটা জবর দখলের হাত থেকে রক্ষা পান। বুধবার তিনি এসেছিলেন কিছু অনুদানের আশায়। ‘কিঞ্চিৎ হলেও বঞ্চিত করা হবে না’ বলে কথা দেয়া হয়।
উপজেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান ভূমি অফিস। এ অফিসে সেবা গ্রহণ করতে আগতদের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করে দেয়া হয়েছে একটি ঘর। নাম দেয়া হয়েছে ‘সেবানন্দ’। সেবা গ্রহীতারা যাতে কোন রকম ভোগান্তিতে না পড়ে সেজন্যই এ প্রয়াস।
এভাবে যে কোন সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান না করতে পারলেও অন্তত কেউ যাতে নিরানন্দ হয়ে ফিরে না যায় সেজন্যই চালু করছেন ‘সেবানন্দ’।
গত বছর(২০১৭) ১৫ সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে যোগদান করেন দেবাশীষ চৌধুরী। এরপর থেকে তিনি উপজেলার কিছু বিরল জায়গা পরিদর্শন করেন। এর মধ্যে জিনিয়া ওষুধি বাগান পরিদর্শন করে তিনি অর্জন করেন নতুন অভিজ্ঞতা। উপজেলার কাতিয়ানাংলার কবিরাজ নাজনীন আক্তার নিপা ও তার স্বামী মোঃ আইয়ুব আলীর বাড়ির ওই ওষুধি বাগান পরিদর্শনকালে আইয়ুব-নিপা দম্পতির মেয়ের পড়াশুনার জন্য প্রতিমাসে এক হাজার টাকা করে টিউশন ফি’ বাবদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সেইসাথে মেয়ের লেখাপড়া শেষে এলাকায় একটি ভেষজ কলেজ স্থাপনের যে স্বপ্ন রয়েছে তা’ বাস্তবায়নেও পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। ওই বাড়িতে প্রায় আড়াই হাজার প্রজাতির ওষুধি গাছ দেখেও মুগ্ধ হন ইউএনও।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লোকজের ১৪শ’ প্রজাতির বীজ সংরক্ষণের ব্যাপারটিও ব্যতিক্রম বলে মনে হয়েছে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের যে কোন কৃষি বিষয়ক উদ্ভাবনে তিনি সহযোগিতার হাত বাড়াবেন।
বটিয়াঘাটাকে পর্যটনের সম্ভাবনাময় এলাকা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানোই তার মূল লক্ষ্য। ইতোমধ্যে শেখ রাসেল ইকোপার্কের ব্যাপারেও সরকারের কাছ থেকে বেশ সহযোগিতা পাওয়া গেছে। এক কোটি টাকা ব্যয়ে বিরাট খেয়াঘাটের উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে। এতে উপজেলার পূর্বপ্রান্তের তিনটি ইউনিয়নের বাসিন্দাদের আর রূপসা সেতু ঘুরে উপজেলা সদরে আসতে হবে না। এমনকি বিরাট খেয়াঘাটের পাশের খাস জমিতেই পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলারও স্বপ্ন রয়েছে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের
সাম্প্রতিক সময়ের দেশব্যাপী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আলোচিত হয়ে আসছে সেটি হচ্ছে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা। বটিয়াঘাটা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এজন্য নেয়া হয়েছে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। যার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই ৪০ হাজার লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে উপজেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে। লিফলেটে ‘নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতকরণে আমাদের করণীয়’ নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। রয়েছে কিছু ট্রাফিক সাইনও। দেয়া হয়েছে টোলফ্রি ৯৯৯ নম্বরও। লিফলেটটির একটি অংশ ছিড়ে অভিভাবকের স্বাক্ষর সম্বলিত অংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে জমা দিতে হবে এমন নির্দেশনাও রয়েছে। এরফলে ওই শিক্ষার্থী ও তার পরিবারের সকলেই সড়ক নিরাপত্তার এসব প্রাথমিক ধারণাগুলো সম্পর্কে অবহিত বলেও প্রমাণিত হবে।
সেবার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া বটিয়াঘাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, বটিয়াঘাটার ইউএনও’র ‘সেবানন্দ’ উদ্যোগটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। তিনি ইতোমধ্যেই তার সাথে কথা বলেছেন এবং তিনিও তাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। জেলা প্রশাসক হিসেবে তাকে দিয়েই এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করানোরও ইচ্ছা রয়েছে ইউএনও’র। তিনি শীঘ্রই একদিন সময় করে সেখানে গিয়ে ‘সেবানন্দ’ উদ্বোধন করবেন। এটি একটি ইতিবাচক উদ্যোগ উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন, সেবা নিতে জনগণ আসবে, জনগণকে উপজেলা প্রশাসন স্বাগত জানাবে, সরকারের সেবাগুলো দেবে এবং জনগণও সেবা পেয়ে স্বস্তিবোধ করবে এটা সত্যি একটি ভাল উদ্যোগ। এভাবে সেবার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসলে জনগণের সাথে প্রশাসনের দূরত্বও কমবে। থাকবে না কোন ভোগান্তিও।
কথা হয় বটিয়াঘাটা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম খানের সাথেও। তিনি বলেন, আগে-পরের অনেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার তিনি দেখেছেন। অনেকের চেয়েই বর্তমান ইউএনও’র মধ্যে সেবার মানসিকতা ভাল। অন্তত সাধারণ মানুষ অনায়াসেই তার কক্ষে প্রবেশ করতে পারছেন, কথা বলতে পারছেন এটিই বড় পাওয়া। এর মাধ্যমে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সরকারের সব সেবা জনগণের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেয়া সম্ভব বলেও তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, শাসক নয়, সেবক হিসেবে কাজ করলেই জনগণের মন জয় করা সম্ভব।
বটিয়াঘাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেবাশীষ চৌধুরী বলেন, তার ‘সেবানন্দ’ কর্মসূচীর মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষের ভোগান্তি নয়, সেবাদান। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার দরজা থাকবে খোলা। অফিসের পর অফিসিয়াল কার্যক্রম বন্ধ হলেও সেবার দুয়ারটি যাতে বন্ধ না হয় সেজন্য সরকারি মোবাইল ফোনটি থাকবে তার সাথে। জনগণের যে কোন প্রয়োজনে, যে কোন সময়ে তিনি নিজের, পরিবারের, সন্তানের চেয়ে জনগণের চাহিদাকেই গুরুত্ব দেবেন এটিই তার মূল উদ্দেশ্য। নাম-জারি করতে কি কি কাগজ প্রয়োজন, অন্যান্য কি সেবার জন্য কি লাগবে তারও একটি বিলবোর্ড থাকবে উপজেলা প্রশাসনের দপ্তরের সামনে। অনেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কাগজপত্র নিয়ে আসতে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে অথবা ধুলাবালিতে নষ্ট হতে পারে। এজন্য চালু করা হবে ‘সেবা খাম’।
সূত্রঃ পূর্বাঞ্চল নেট।