স্বপ্নের ইউরোপযাত্রার প্রলোভনে প্রতি বছরই প্রাণ যাচ্ছে বাংলাদেশিদের। মানবপাচারীদের স্বর্গরাজ্য লিবিয়ায় ২৬ নিরীহ বাংলাদেশিকে মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের ঘটনা নাড়া দেয় গোটা বিশ্বকে। শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা মানবপাচারকারীদের কঠোর ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্মূলে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.বেনজীর আহমেদ, বিপিএম (বার)।
ফলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে শুরুতেই মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে শুরু থেকেই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান। মানবপাচার চক্র নির্মূলে কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ক্রমশ সাফল্যের মুখও দেখছেন তারা।
সিআইডি’র অব্যাহত অভিযানে নিয়মিতই মানবপাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্যরা গ্রেফতারের পাশাপাশি নজরদারিতে রয়েছেন গডফাদাররাও। তাদের ধারাবাহিক অ্যাকশনে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে মানবপাচার চক্রের শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
লিবিয়ার নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনায় দেশের বিভিন্ন থানায় দায়ের করা ২৬টি মামলার ১৫টিই তদন্ত করছে সিআইডি। এসব মামলায় ৬৭ জনের মধ্যে ৩৬ জনকেই গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ।
সিআইডি প্রধান হিসেবে গুরুপূর্ণ দায়িত্ব নেওয়ার পর সোমবার (০৬ জুলাই) প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান। রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্যই উপস্থাপন করেছেন সিআইডি চীফ।
সিআইডির সামগ্রিক কর্মকান্ড নিয়ে সংবাদ সম্মেলন হলেও এর বড় অংশজুড়েই ছিল মানব পাচার প্রসঙ্গ। মানব পাচারের দায়ে কুয়েতে গ্রেফতার সংসদ সদস্য মো. শহিদ ইসলাম পাপুলের বিষয়ে তদন্ত, লিবিয়ার ঘটনায় জড়িত তিন গডফাদারকে শনাক্ত, মানিলন্ডারিং, যুবলীগের বহিস্কৃত নেত্রী পাপিয়া, সিআইডি’র তদন্তকে আরও গতিশীল করাসহ বিভিন্ন বিষয়েই খোলামেলা কথা বলেছেন পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে নেতৃত্বে আলো ছড়ানো ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান।
সংবাদ সম্মেলনে আরেকটি সুসংবাদও দিয়েছেন সিআইডি প্রধান। বলেছেন, ‘সিআইডি সাইবার থানা স্থাপন করবে। ঢাকায় থানাটি স্থাপন করা হলেও সারা দেশ থেকে অনলাইনে এই থানায় অভিযোগ দায়েরের সুযোগ পাবেন ভুক্তভোগীরা।’
মানবপাচার, লিবিয়ার ঘটনায় জড়িত তিন গডফাদার
মানবপাচারকারীদের বিষয়ে সরকারের দুটি মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে আমরা দুটি তালিকা পেয়েছি, সংবাদ সম্মেলনে বলেন সিআইডি প্রধান। তিনি বলেন, ‘এছাড়াও পাচার হওয়া ভুক্তভোগী, তাদের পরিবার ও বিভিন্ন দেশের অ্যাম্বাসির কাছ থেকে অনেক নাম পাওয়া গেছে। তাদেরও আমরা নজরদারিতে রেখেছি।’
ব্যারিস্টার মাহবুবুর আরও বলেন, লিবিয়ায় মানবপাচারের ঘটনায় ২৬ বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১১ জন। এ ঘটনায় জড়িত গডফাদারদের তিনজনের সম্পর্কে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই আমরা কিছু বলতে চাচ্ছি না।
তিনি বলেন, মানবপাচারকারী যারা আটক হয়েছেন তাদের কাছ থেকেও আমরা অনেক নাম পেয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এছাড়াও আমরা মানবপাচারকারী চক্রের গডফাদারদের বিষয়ে বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান করছি। তাদের গ্রেফতার করতে পারলে অবশ্যই সামনে নিয়ে আসব। আমরা আইনি সকল প্রসিডিউর মেনেই কাজ করছি, যাতে গ্রেফতারের পর অপরাধানীরা কোন ছাড় না পায়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানা হয়, সিআইডি ইতোমধ্যেই ৩৬ জন পাচারকারীকে গ্রেফতারের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদে বিভিন্ন তথ্য পেয়েছে। এ সময় গ্রেফতার হওয়া একটি এজেন্সির পিয়নের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা রয়েছে বলে জানতে পেরেছেন সিআইডির তদন্তকারীরা।
সাংসদ পাপুলের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ
মানবচাপারের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে কুয়েতে আটক হয়েছেন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য শহীদুল ইসলাম পাপুল। তার সম্পর্কে সিআইডি কী ব্যবস্থা নিয়েছে জানতে চাইলে অতিরিক্ত আইজিপি ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা এ বিষয়ে সকল প্রকার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি।
এছাড়াও এটি আন্তর্জাতিক একটি ইস্যু হওয়ায় অনেক বিষয়ে বিবেচনা করেই কাজ করতে হচ্ছে। আশা করি খুব শিগগিরই এ বিষয়ে জানাতে পারব।
মানিলন্ডারিং ১২ টি মামলা তদন্তাধীন
সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান আরও বলেন, আমরা মানিলন্ডারিং মামলার বিষয়েও তদন্ত শুরু করেছি। প্রথমে প্রাথমিকভাবে অনুসন্ধান করতে হয়, এরপর যে তথ্য পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে মামলা হয়। সেই মামলার তদন্ত সিআইডি করে থাকে। এখন পর্যন্ত আমরা তিনজন ব্যক্তির ফাইল ওপেন করেছি। তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে।
সিআইডির কাছে মানিলন্ডারিং আইনে ১২টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত দুটি মামলার তদন্ত চলছে। ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে খালেদ মাহমুদের বিরুদ্ধে একটি মামলার চার্জশিট রয়েছে।
আবার নতুন করে তার বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। আশা করি এ মাসেই দুটি মামলার নিষ্পত্তি হবে। একই সাথে এই মামলাগুলোর তদন্ত করতে গিয়ে আমরা মানিলন্ডারিংয়ের নতুন নতুন এভিডেন্স পেয়েছি।’
পাপিয়ার সম্পদের বিষয়ে তদন্ত
যুবলীগের বহিষ্কৃত নেত্রী পাপিয়ার বিষয়ে অতিরিক্ত আইজিপি ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে পাপিয়া ইস্যুটি একটু ঝিমিয়ে আছে। ইতোমধ্যে আমরা তার যত সম্পদ রয়েছে সমস্ত কিছুর বিষয়ে তদন্ত করেছি।
তিনি বলেন, আপনারা জানেন এসব তদন্ত করতে আমাদের চব্বিশটি অর্গানাইজেশনের কাছ থেকে তথ্য আনতে হয়। এর মধ্যে বেশ কিছু তথ্য এসেছে আর বাকি কিছু তথ্য আসলে তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
গতিশীল সিআইডির তদন্ত কার্যক্রম
সিআইডির তদন্তকে আরও গতিশীল করার কাজ চলছে, এমনটিই জানিয়েছেন অতিরিক্ত আইজিপি, সিআইডি প্রধান মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আগে ৬০ বা ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৌখিক স্বীকারোক্তির ওপর সিআইডি নির্ভর করত, এখন ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ফরেনসিক সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করার চেষ্টা চলছে।’
ব্যারিস্টার মাহবুবের ভাষ্য হচ্ছে- ‘বিভাগটি ২২ ধরনের মামলা করে থাকে। ৮২ ভাগ ক্ষেত্রে তারা অভিযোগপত্র দিয়েছে, তবে সাজা হয়েছে ২৪ ভাগ ক্ষেত্রে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কেন শাস্তির হার কম, তা জানতে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। বিচারক ও আইনজীবীদের নিয়ে গঠিত কমিটি মাস খানেকের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে।
সংবাদ - কালের আলোর।