বহুমুখী ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণেই পুলিশ বাহিনী ভাসছে প্রশংসার বন্যায়। বদলে গেছে তাদের ভাবমূর্তি। এখন তাদের বলা হচ্ছে মানবিক পুলিশ।
কদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পুলিশ সদর দপ্তরে গিয়ে বলেছেন, এমন জনবান্ধব পুলিশ আগে দেখেনি কেউ।মানুষ যখনই কোনো অসহায় অবস্থায় পড়েছে, তখনই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে পুলিশ। জঙ্গিবাদ দমন থেকে শুরু করে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশের ভূমিকা বঙ্গবন্ধুর জনতার পুলিশের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমরা এখন তাদের নাগরিক সেবার প্রত্যয় দেখে গর্ববোধ করি।
পুলিশের এই প্রশংসাসিক্ত হওয়া কিংবা গর্ববোধের জায়গাটি তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে একটা উপলক্ষ হিসেবে সামনে আসে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস। আর এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে পুলিশের ভূমিকা পালন ও মানবিক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অবধারিতভাবে সামনে আসে বাহিনীপ্রধান মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদের সৃজনশীল নেতৃত্ব। দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর ঠিক এক মাসের মাথায় আইজিপির দায়িত্ব পান ড. বেনজীর।
করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই কোনো ধরনের ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর জন্য অপেক্ষা না করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুলিশের সদস্যরা জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ফলে অনেক সদস্যই নিজের অজান্তে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, হার মেনেছেন মৃত্যুর কাছে। একক বাহিনী হিসেবে সেই সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সংক্রমণ থেকে সদস্যদের সুরক্ষায় সাহসিকতার সঙ্গে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেন বর্তমান পুলিশপ্রধান। দেন বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা।
দেশে ভাইরাসটির প্রভাব শুরুর দুই সপ্তাহের মধ্যে নিজ উদ্যোগে ড. বেনজীর আহমেদ বাড়ান চিকিৎসাসেবার পরিধি। আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার জন্য অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে ভাড়া করেন বেসরকারি একটি হাসপাতাল। মাত্র ১২ দিনের মধ্যে সেখানে স্থাপন করেন পিসিআর ল্যাব ও কেন্দ্রীয় গবেষণাগার। উদ্দেশ্য কোভিড-১৯ সংক্রমণে পুলিশ বাহিনীর মৃত্যুহার শূন্যে ফিরিয়ে আনা। এ নিয়ে পরিকল্পনা করেন, নির্দেশনাও দেন। এতে পুরোমাত্রায় সফল হয়েছেন আইজিপি।তার সুদক্ষ কর্মপরিকল্পনায় পুলিশে মৃত্যু ও আক্রান্ত সবই কমেছে।
সংকটকালে পুলিশ সদস্যদের পাশে থেকে সাহসিক-সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত দেওয়ার কারণে বাহিনীতে অনন্য হয়েছেন আইজিপি ড. বেনজীর।
আমাদের দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে অংশ বিশেষের মধ্যে কিছু ধারণা, ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। শুধু বাংলাদেশ কেন, পুরো বিশ্বেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে মানুষের ধারণা সব সময় ইতিবাচক নয়। করোনাকালে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিশ্বের প্রচারমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রশংসা করা হয়েছে। মানবিক ভূমিকায় পুলিশ জাতির ‘শ্রেষ্ঠ সন্তান’ হিসেবে আবির্ভাব হয়েছে আইজিপি বেনজীর আহমেদের মাধ্যমে।
গত এপ্রিলে পুলিশে যখন করোনা-সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার ঊর্ধ্বগামী, তখন বাহিনীর সদস্যদের মানসম্পন্ন চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন আইজিপি। বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালেও কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের মতো একই প্রটোকলে করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করেন। আর এতে মফস্বলেও পুলিশে সুস্থতা বেড়ে মৃত্যুহার কমে আসে। এর মধ্য দিয়ে বাহিনীর সদস্যদের করোনাযুদ্ধের মনোবল বাড়ে বহুগুণ। একজন সৃষ্টিশীল, চৌকস নেতৃত্বের আইজিপি বেনজীর আহমেদের প্রতি এভাবে শতভাগ আস্থায়; পুলিশ বাহিনী আরও উজাড় করে দেন নিজেদের কাজে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে পুলিশের স্লোগান ছিল ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার’। পুলিশের এই স্লোগানের যথার্থতার প্রমাণ মেলে করোনা দুর্যোগকালে তাদের মানবিক ভূমিকা রাখার মধ্য দিয়ে। ড. বেনজীর আইজিপির দায়িত্ব যখন পান, তখন দেশজুড়ে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের তাণ্ডব চলছিল। তার পরিকল্পনায় পুলিশ নিজ চৌহদ্দির বাইরে গিয়ে মানবিক পুলিশ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এখনো তাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। করোনায় মৃত ব্যক্তিকে যখন আপনজনরা ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তখন পুলিশ গিয়ে তাদের দাফন ও সৎকার করছে।
ড. বেনজীর আহমেদ এর আগে যেসব শীর্ষপদে দায়িত্ব পালন করেছেন, সবখানেই নতুন ভাবনা ও উদ্যোগের মাধ্যমে বাহিনীর উন্নয়ন, এর সদস্যদের পেশাদারি দক্ষতা বৃদ্ধি, জনগণের সঙ্গে সেতুবন্ধ রচনা করে দেশসেবায় ব্রতী হয়েছেন।
আইজিপির দায়িত্ব পাওয়ার পর সব সময় চেষ্টা করছেন থানার বাইরে পুলিশের সঙ্গে জনগণের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার। দুই লাখ পুলিশের সঙ্গে ১৭ কোটি মানুষের যোগাযোগকে সহজ ও সুহৃদ করতে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনাও তার। নানাভাবে প্রশংসা পাওয়া পুলিশের বর্তমান সুনাম তিনি ধরে রাখতে চান আগামী দিনেও।
করোনা মহামারিতে মাঠপর্যায়ে বিপদগ্রস্ত, গরিব-অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানবতার হাত বাড়িয়ে দেয় পুলিশ। খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছে দেশব্যাপী। করোনায় আক্রান্তদের হাসপাতালে নেওয়া, চিকিৎসা, ওষুধ-পথ্যের ব্যবস্থা করা, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন করার মতো মানবিক দায়িত্ব পালন করেছে পুলিশপ্রধানের নির্দেশনায়।
নিয়মিত কাজের পাশাপাশি এসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৭৪ জন পুলিশ সদস্য। করোনায় কোনো বাহিনীতে এটাই সর্বোচ্চ মৃত্যু। সুষ্ঠু চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার কল্যাণে এরপর পুলিশের আর কোনো নিয়মিত সদস্য করোনায় প্রাণ হারাননি।
কোভিড-১৯ সংক্রমণে মৃত্যুহার শূন্যে নামাতে আইজিপির পরিকল্পনা
কোভিড-১৯ সংক্রমণে পুলিশ বাহিনীর মৃত্যুহার শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনতে বিভিন্ন পরিকল্পনা করেন পুলিশপ্রধান ড. বেনজীর আহমেদ। মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে ২৫০ শয্যার হাসপাতালকে ৫০০ শয্যায় রূপান্তরের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম বৃদ্ধি করেন। করোনায় বাহিনীর সদস্যদের সুরক্ষিত রেখে দায়িত্ব পালনের জন্য বিপুল মাস্ক, পিপিই, স্যানিটাইজার সামগ্রী কেনার ব্যবস্থা করেন। পুলিশের প্রতিটি সদস্যকে সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শৈথিল্য দেখানো হবে না বলেই তিনি এ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
এছাড়া পুলিশের জন্য ভিটামিন সি, ডি এবং জিংক ট্যাবলেট কিনে সেগুলো বিভিন্ন ইউনিটে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পুলিশের কোনো সদস্য করোনায় আক্রান্ত হলে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থার পাশাপাশি অন্যান্য হাসপাতালেও পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা রাখা হয়। নিয়োগ দেওয়া হয় হোমিও চিকিৎসক।
করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের সুচিকিৎসার জন্য রাজধানীর বেসরকারি ইমপালস্ হাসপাতাল ভাড়ার ব্যবস্থা এবং সেখানে ১২ দিনের মধ্যে পিসিআর ল্যাব ও কেন্দ্রীয় গবেষণাগার স্থাপন করেন।
চীনের বিশেষজ্ঞ দলের প্রশংসা
করোনাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গঠিত বিশেষজ্ঞ মেডিকেল টিম দেশের অনেক হাসপাতাল পরিদর্শন করে। দলটি কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে করোনা চিকিৎসাকে ‘সেরা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। এছাড়া চীনের বিশেষজ্ঞ মেডিকেল টিমও কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের মেডিকেল প্রটোকল ও ব্যবস্থাপনার প্রশংসা করে।
মহামারিতে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে
মহামারির সময়ে পুলিশের যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে, সেখান থেকে বাহিনীর সদস্যরা সরে আসবেন না। বেনজীর আহমেদ একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘একদিন করোনা চলে যাবে। এরপর কী হবে, আমরা কি আবারও আমাদের আগের স্বরূপে আবির্ভূত হব? স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পুলিশ এত সম্মান, এত মর্যাদা আর কখনো পায়নি, করোনায় আমরা যা পেলাম। এখন জনগণ পুলিশের পক্ষে কথা বলছে, পুলিশের জন্য লিখছে। যারা কথায় কথায় পুলিশের সমালোচনা করতেন, তারাও পুলিশের পক্ষে হৃদয় উজাড় করে বলছেন, পুলিশকে সমর্থন করেছেন। যে সম্মান ও মর্যাদা আমরা পেয়েছি তা টাকা দিয়ে কেনা যায় না। মানুষের ভালোবাসা পেতে হলে মানুষের সঙ্গে থাকতে হয়, তাদের কাছে যেতে হয়, মানুষকে ভালোবাসতে হয়।’
পুলিশকে দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে
জনগণের পুলিশ হতে হলে পুলিশকে সব ধরনের দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান এখন শূন্য সহনশীল। পুলিশে কোনো দুর্নীতিবাজের ঠাঁই নেই। মাদকের সঙ্গে কোনো পুলিশ সদস্যের সম্পর্ক থাকবে না। পুলিশকে হতে হবে মাদকমুক্ত। পুলিশের নিষ্ঠুরতা বন্ধ করে আইনি সক্ষমতা কাজে লাগাতে কাজ করছেন পুলিশপ্রধান।
পুলিশে ‘বদলি তদবির’ চিরতরে বিদায় হবে
পুলিশে ‘বদলি তদবির কালচারকে’ চিরতরে বিদায় করার ঘোষণাও দিয়েছেন বেনজীর আহমেদ। গতানুগতিক ধারাকে পাল্টে বদলিতে নতুনত্ব আনা হয়েছে। ঢাকার বাইরে পুলিশ কর্মকর্তাদের পাঠাতে বিভাগীয় শহরগুলোয় মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে কাজ করছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক।
আইজিপি হয়ে ওঠা
চলতি বছরের ৮ এপ্রিল দেশের ৩০তম আইজিপি হিসেবে নিয়োগ পান ড. বেনজীর আহমেদ। ১৫ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেন তিনি। এর আগে তিনি র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মেধাবী, সৎ ও চৌকস কর্মকর্তা হিসেবে সুপরিচিত বেনজীর আহমেদ ১৯৬৩ সালের ১ অক্টোবর গোপালগঞ্জের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ এবং এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। সপ্তম বিসিএসের মাধ্যমে ১৯৮৮ সালে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। র্যাবের ডিজি হিসেবে সাড়ে পাঁচ বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালনের আগে তিনি প্রায় সাড়ে চার বছর ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ছিলেন। পুলিশ সদর দপ্তরে ডিআইজি (প্রশাসন), ডিআইজি (অর্থ)সহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদে দক্ষতা, যোগ্যতা ও মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার কিংবা ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার হিসেবেও অত্যন্ত সফলতার সাথে কাজ করেছেন। এছাড়া জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রেখেছেন মেধা আর দক্ষতার ছাপ। ২০১৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
পুলিশের সর্বোচ্চ পদক লাভ
বেনজীর আহমেদ চাকরিজীবনে সর্বোচ্চ সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেছেন পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম)। ২০২০ সালে ষষ্ঠবারের মতো বিপিএম (সাহসিকতা) অর্জনের রেকর্ড গড়েন তিনি। এর আগে ২০১১, ২০১২, ২০১৪, ২০১৬ ও ২০১৯ সালে এই পদক তার সাফল্যের মুকুটে যোগ হয়।
সংবাদ ঢাকা টাইম্সের।