বাংলা ব্যান্ড সংগীতের অন্যতম পথিকৃৎ আইয়ুব বাচ্চু। যার সুরের মূর্ছনায় ও গিটারের তালে মাতোয়ারা হতেন দর্শক-শ্রোতারা। এখনো তার পুরোনো গান আন্দোলিত করে অসংখ্য ভক্ত-শ্রোতাদের। ১৯৬২ সালের আজকের দিনে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সংগীতের অন্যতম এই জাদুকর।
বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীতের চর্চা শুরু হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পর। সেই সময় পিংক ফ্লয়েড, বিটলস, ডায়ার স্ট্রেইট বা দা ডোরস’র মতো পাশ্চাত্যের ব্যান্ডগুলোতে বুঁদ হয়ে থাকত দেশের তরুণরা । তাদের কেউ হতে চাইতেন বিখ্যাত মার্ক নফলার, জিম মরিসন। আবার কেউ ডেভিড গিলমোর অথবা জিমি হেনড্রিক্স।
শৈশবকাল থেকেই গিটারের প্রতি অদ্ভুত প্রেম ছিল আইয়ুব বাচ্চুর। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় সংগীতের প্রতি তার প্রেমটা পরিবার মেনে নেয়নি। পেশা হিসেবে তো একেবারেই না। কিন্তু এসব কিছু তাকে কখনোই আটকে রাখতে পারেনি।
আমেরিকান গিটারিস্ট জিমি হেনড্রিক্সকে দেখার পর গিটারের বিষয়টা প্রথম সংক্রমিত করে আইয়ুব বাচ্চু মগজে। গিটারের প্রতি ছেলের এমন অগাধ প্রেম দেখে তার বাবা ইশহাক চৌধুরী এবির ১১তম জন্মদিনে গিটার উপহার দেন। এরপর থেকেই শুরু হয় গিটারের তারে টু-টাং শব্দ তোলা। যা পরবর্তীতে ছুঁয়ে যায় উপমহাদেশের আনাচে-কানাচে।
১৯৭৮ সালে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের মাধ্যমে সংগীত জগতে পথচলা শুরু হয় তার। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ‘সোলস’ ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট ছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে আইয়ুব বাচ্চু নিজেই গঠন করে নতুন ব্যান্ড ‘এলআরবি’ তথা লিটল রিভার ব্যান্ড।
ব্যান্ডের নামে তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘এলআরবি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। যেটি ছিল দেশের প্রথম ডাবল অ্যালবাম। এলআরবির অন্য অ্যালবামগুলো হলো-‘সুখ’ (১৯৯৩), ‘তবুও’ (১৯৯৪), ‘ঘুমন্ত শহরে’ (১৯৯৫), ‘ফেরারি মন’ (১৯৯৬), ‘আমাদের’ (১৯৯৮), ‘বিস্ময়’ (১৯৯৮), ‘মন চাইলে মন পাবে’ (২০০১), ‘অচেনা জীবন’ (২০০৩), ‘মনে আছে নাকি নাই’ (২০০৫), ‘স্পর্শ’ (২০০৮), ‘যুদ্ধ’ (২০১২), ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ (২০১৬)।
আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। তবে তিনি বেশি সাফল্য পান দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না’ (১৯৮৮) দিয়ে। ১৯৯৫ সালে বাজারে আসে তার তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। ‘কষ্ট কাকে বলে’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘অবাক হৃদয়’, ‘আমিও মানুষ’সহ এর প্রায় সব গানই জনপ্রিয়তা পায়। আইয়ুব বাচ্চুর অন্য একক অ্যালবামগুলো হলো- ‘সময়’ (১৯৯৮), ‘একা’ (১৯৯৯), ‘প্রেম তুমি কি’ (২০০২), ‘দুটি মন’ (২০০২), ‘কাফেলা’ (২০০২), ‘রিমঝিম বৃষ্টি’ (২০০৮), ‘বলিনি কখনো’ (২০০৯) ও ‘জীবনের গল্প’ (২০১৫)।
বাচ্চুর গাওয়া জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘চলো বদলে যাই’, ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি’, ‘ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘হকার’, ‘সুখ’, ‘রুপালি গিটার’, ‘গতকাল রাতে’, ‘তারা ভরা রাতে’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘ফেরারি মন’, ‘মেয়ে’, ‘সুখের এ পৃথিবী’, ‘উড়াল দেবো আকাশে’, ‘বাংলাদেশ’, ‘আমি বারো মাস তোমায় ভালোবাসি,’ ‘এক আকাশের তারা’, ‘কবিতা’, ‘যেওনা চলে বন্ধু,’ ‘বেলা শেষে ফিরে এসে,’ ‘তিন পুরুষ’ইত্যাদি।
চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেও শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন তিনি। চলচ্চিত্রে তার গাওয়া প্রথম গান ‘লুটতরাজ’ সিনেমার ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’। তার গাওয়া ‘আম্মাজান’ সিনেমায় টাইটেল এবং ‘ব্যাচেলর’ সিনেমার ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি’ও বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এছাড়া আরও কিছু সিনেমায় তিনি কণ্ঠ দেন। সিনেমায় তার সুর-সংগীতায়োজন করা কিছু গানও বেশ প্রশংসা কুড়ায়।
২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর রংপুর জিলা স্কুলে ‘শেকড়ের সন্ধানে’ নামে এক কনসার্টে পারফর্ম করার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর দুই দিন পর অর্থাৎ ১৮ অক্টোবর বাসা থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান তিনি। তার সম্মানে জন্মস্থান চট্টগ্রামে ২০১৯ সালে ‘রুপালি গিটার’ নামে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। বেঁচে থাকলে ৬১ বছর পূর্ণ করতেন এই সংগীত কিংবদন্তি।