★★★
সিটিজেন জার্নালিস্ট(জিমি):
আজ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা অবিস্মরণীয় গৌরবের এক অনন্য দিন। সুদীর্ঘকালের আপসহীন আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৭১ সালের এই দিনে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক উত্তাল জনসমুদ্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বঙ্গবন্ধুর এই তেজদৃপ্ত ঘোষণাই ছিল প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে গত বছর অক্টোবরে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই এবার অনেকটা জাঁকজমকপূর্ণভাবে দিবসটি পালনে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
দিবসটি পালনে আজ বুধবার অপরাহ্নে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ। জানা গেছে, এবার ঐতিহাসিক ৭ মার্চে আরেকটি ইতিহাস গড়তে চায় আওয়ামী লীগ। ভাঙতে চায় লোক সমাগমের অতীতের সকল রেকর্ড। এজন্য ব্যাপক প্রস্তুতি ক্ষমতাসীনদের। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে ঢাকায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জনসভাও এটি। এ জনসভায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দিক-নির্দেশনামূলক বার্তা দিবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচনকে সামনে রেখে তৃণমূল নেতাকর্মীদের গাইডলাইনও দেওয়া হবে। জানা গেছে, এবারের জনসভায় ১৫ লাখ মানুষের উপস্থিতির টার্গেট নেওয়া হয়েছে। জনসভা সফল করতে গত তিন দিন ধরে ঢাকা মহানগরীতে লিফলেট বিতরণ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এছাড়া আওয়ামী লীগ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের স্মৃতি-বিজড়িত ৭ই মার্চ উপলক্ষে দেশব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ ভোর সাড়ে ৬টায় বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় এবং দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণ থেকেই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ১৯৬৬’র ৬-দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচনের পর যখন বাংলার জনগণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা শুনতে অধীর আগ্রহে বসেছিল, তখনই ১৯৭১ সালের এই দিনে তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করার জন্য দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। সেদিন উত্তাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাংলার মুক্তিকামী জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক রেসকোর্সে এ ভাষণ যখন দিচ্ছিলেন ঠিক ওইদিনই ঢাকায় এসে পৌঁছান জেনারেল টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলী। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আলোচনার অন্তরালে সামরিক প্রস্তুতিই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণ এ দেশের জনগণকে দারুণভাবে আন্দোলিত করে। ৭০’র ঐতিহাসিক নির্বাচনে বাংলার মানুষের ভোটে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনার আড়ালে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহার কারণে বাংলার মুক্তকামী মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিতে ৬ মার্চ পর্যন্ত ঘোষিত হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন চলে। ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিত পল্টনের জনসমাবেশে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ৬ মার্চের মধ্যে যদি সরকার তার অবস্থান পরিবর্তন না করে তাহলে ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। পরাধীনতার দীর্ঘ প্রহর শেষে পুরো জাতি যখন স্বাধীনতার জন্য অধীর অপেক্ষায়, ঠিক তখনই ঘোষণা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক সেই ৭ই মার্চের জনসভা। গত ৪/৫ দিনের ঘটনাবলীতে বিক্ষুব্ধ মানুষ নতুন কর্মসূচির অপেক্ষায় ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু জনসভায় আসতে একটু বিলম্ব করেন। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হবে কি হবে না, এ নিয়ে তখনো রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলছে নেতৃবৃন্দের মধ্যে। বেলা ঠিক সোয়া ৩টায় সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি ও মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে ওঠেন তখন বাংলার বীর জনতা করতালি ও স্লোগানের মধ্যে তাঁকে অভিনন্দন জানান। মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু যখন জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন তখন পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান লাখ লাখ বাঙালির ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। এরপর বঙ্গবন্ধু ২২ মিনিট তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম এবং ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করেন।
আজ থেকে ৪৬ বছর আগে অগ্নিঝরা একাত্তরের এইদিনে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন একমাত্র বক্তা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্বে আ স ম আব্দুর রব, নুরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ নেতা মঞ্চ থেকে মাইকে নানা ধরনের স্লোগান দিয়ে উপস্থিত জনতাকে উজ্জীবিত রাখেন।
বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের বয়স ৪৬ বছর। সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছুই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। বিকৃতির নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রের আবহে বদলে ফেলার চেষ্টা হয়েছে স্বাধীনতার অনেক ইতিহাস। কিন্তু এ ৪৭ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেলেও বদলানো যায়নি শুধু ২২ মিনিটের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি। বিশ্বের অনেক মনীষী বা নেতার অমর কিছু ভাষণ আছে। বিশ্বের মধ্যে এই একটি মাত্র ভাষণ, যা যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেজে চলেছে কিন্তু ভাষণটির আবেদন এতটুকু আজও কমেনি।
তথ্যঃডেইলি সাতক্ষীরা ডটকম।