নিউ জিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে সম্প্রতি অসংখ্য মুসল্লি হত্যা করেছে অস্ট্রেলিয়ান এক উগ্রবাদী সন্ত্রাসী। ভাগ্য ভালো যে, মিনিট পাঁচেক পরে রওনা দেওয়ায় প্রাণে বেঁচে গেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। হয়তো ওই সন্ত্রাসীর মূল টার্গেট ছিল বাংলাদেশি ক্রিকেটাররাই। নইলে টেস্ট চলার সময় এবং শুক্রবার বেছে নেওয়া হবে কেন? নিউ জিল্যান্ড পুলিশের এ বিষয়টা খতিয়ে দেওয়া উচৎ। নিউজিল্যান্ড পুলিশ চাইলে বাংলাদেশ পুলিশের সহযোগিতাও গ্রহণ করতে পারে। কারণ এই দিক দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ বেশ অভিজ্ঞ এবং বিচক্ষণ।

ক্রাইস্টচার্চের ‍পুলিশের কিছু বুঝে ওঠার অগেই সাম্প্রতিক বছরগুলোর সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটা ঘটে গেল। নিউজিল্যান্ডকে এবং পুরো বিশ্বকে হতবাগ করে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে গেলেন ওই চরম ডানপন্থি উগ্রবাদী।

তবে আমি বলবো নিউজিল্যান্ড পুলিশের আগেভাগে সচেতন ও সতর্ক হওয়া উচিৎ ছিল। কারণ ওই অস্ট্রেলিয়ান উগ্রাবাদী বিগত চার মাস ধরেই এমন হামলার পরিকল্পনা করে আসছিল। ফেসবুকে নানা সময়ে উগ্রবাদী মন্তব্যও করেছে সে। নিউজিল্যান্ড পৌঁছা মাত্র তার উপর বিশেষ নজরদারী রাখা দরকার ছিল সেদেশের পুলিশের।

ক্রাইস্টচার্চের ঘটনা যে কোনো দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য সতর্কবার্তা ও শিক্ষনীয় বিষয়। কারণ জঙ্গিবাদ আজ যে কোনো দেশের ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে একটি সার্বজনীন সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটা সব দেশেরই অভিন্ন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমি মনে করি, জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই বাংলাদেশ পুলিশ ও আমাদের করিৎকর্মা র‌্যাব বাহিনী মডেল হতে পারে। সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার সন্তান হিসেবে এই বাহিনীর উপর আমার বিশেষ আবেগ, সহানুভূতি আছে সন্দেহ নেই। তবে আপনি যদি জঙ্গি দমনে বিগত বছরগুলোর পরিসংখ্যান সামনে আনেন তাহলে বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাবকে বাহাবা দিতেই হয়। ধন্যবাদ দিতে হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, র‌্যাব প্রধান, ডিএমপি প্রধান, কাউন্টার টেরিজম ইউনিটের প্রধানকে। বিশেষ করে আইজিপি মাহদয়কে। সন্ত্রাস দমনে তাদের আন্তরিকতায় আমরা সবাই মুগ্ধ। মুগ্ধ আমাদের বিভিন্ন বাহিনীর বিচক্ষণতায়।

আমাদের প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মতো এখানেও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছিল এক সময়। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর ত্বরিত ও যথাযথ পদক্ষেপের কারণে সন্ত্রাসীরা আর মাথাচাড়া উঠতে পারেনি। অন্তরের অন্তরস্থল থেকে আমাদের বাহিনীকে আমাদের আন্তরিক সালাম।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অভিযানে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের অনেকেই নিহত এবং আটক হবার কারণে তাদের নেটওয়ার্ক ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে বলে নিরাপত্তা বাহিনী ধারণা করছে। ইন্টারপোল মহাসচিব জার্গেন স্টোক বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। এসে বলে গেছেন , বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার সন্ত্রাস ও জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই দেশটি সফৃলতার সঙ্গে জঙ্গিদের মোকাবেলা করেছে।

জেএমবি, নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল-ইসলাম, হরকাতুল-জিহাদ-আল-ইসলাম (হুজি-বি), হিজবুত তাহরির বাংলাদেশ এবং নতুন আবির্ভূত আল মুজাহিদ এর সম্পৃক্ততা কথা জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। জঙ্গি দমনে ‘জিরো টলারেন্স’নীতির ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো। জঙ্গি দমনে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ আজ ‘রোল মডেল’হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের জঙ্গি দমন সক্ষমতায় রীতিমতো অবাক সারা বিশ্ব। কারণ অনেক বড়বড় দেশই জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে।

হোলি আর্টিজানের ঘটনার পর ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই অভিযানে নিহত হয় ৯ জন জঙ্গি। একই বছর ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ শহরের পাইকপাড়ার একটি বাড়িতে পুলিশের অভিযানে তিন জঙ্গি নিহত হয়। ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকার একটি বাড়ির ছয়তলার বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। পুরান ঢাকার আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময়ে নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করেন তানভীর কাদেরী নামের এক জঙ্গি। ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তার স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ও এক ছেলেকে। গাজীপুরের পাতারটেক ও টাঙ্গাইল এলাকায় পৃথক জঙ্গি আস্তানায় যৌথবাহিনীর অভিযানে সন্দেহভাজন ১১ জঙ্গি নিহত হয়। রাজধানীর দক্ষিণখান থানার পূর্ব আশকোনার ৫০ নম্বর বাড়ির সূর্য ভিলায় অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর পুলিশের বিশেষ শাখার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ইউনিট।

জঙ্গি দমনে সরকার কাউণ্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট গঠন করেছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর বেশ কিছু সফল অভিযান পরিচালনার ফলে শীর্ষস্থানীয় জঙ্গিনেতাসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদস্য গ্রেপ্তার ও নিহত হয়েছে। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলা-বারুদ উদ্ধার হয়েছে। হোলি আর্টিজান হামলার পর এ যাবৎ যতগুলো অপারেশন পরিচালিত হয়েছে তার সবগুলো থেকেই জঙ্গিগোষ্ঠী আঘাত হানার পূর্বেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছে এবং জঙ্গি আস্তানাসমূহ গুঁড়িয়ে দিয়েছে। জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ প্রো-অ্যাক্টিভ পুলিশিং এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অভিযানসমূহ পরিচালনার ফলে বর্তমানে জঙ্গি তৎপরতা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে এবং জঙ্গি দমনে এ সাফল্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করেছে। সন্ত্রাস দমনে শেখ হাসিনা সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি বিশ্বশান্তির জন্যে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। আর জাতিসংঘ জঙ্গি ছোবলে আক্রান্ত কয়েকটি দেশকে তো বাংলাদেশকে অনুসরণের পরামর্শই দিয়েছে।

বিভিন্ন প্রামাণ্য তথ্যমতে, ১৯৯২ সালে আফগান ফেরত মুজাহিদদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রম শুরু হয়। তাদের অনুসৃত পথে এখন নিষিদ্ধ ও সক্রিয় অর্ধ-শতাধিক জঙ্গি সংগঠন রয়েছে দেশে। নেতৃত্বে আছে আফগান ফেরত মুজাহিদদের কেউ না কেউ।

জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি বেশ কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে শেখ হাসিনার সরকার। সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্ত্রাস ও সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতেও সরকার ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এছাড়া সারাদেশের মাঠ প্রশাসনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন।

সবশেষে বলতে চাই, গরীব দেশের স্বল্প সুবিধাসহ আমাদের পুলিশবাহিনী যেভাবে জঙ্গীবাদ দমন করছে তা অবশ্যই প্রসংশার দাবিদার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুলিশ বাহিনীর কার্যকর্মের প্রতি অনুপ্রাণীত করেছে। তাই আমাদের উচিত পুলিশ বাহিনীকে অনু্প্রাণীত করা।

লেখক:  লিয়াকত আলী ভূঁইয়া : সহ-সভাপতি, রিহ্যাব।

 





০ মন্তব্য

আরও পোস্ট পড়ুন

মতামত দিন