স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ যখন দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন একই নদীর উজানে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের দিকে নজর পড়েছে সরকারের। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার প্রবেশপথ হিসেবে পরিচিত এই ঘাটটিকে আধুনিক ও মাল্টিপারপাস ঘাট হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুস সামাদ প্রতিবেদক কে বলেন, দেশের ব্যস্ততম এই ফেরিঘাটটিকে আধুনিক ঘাট হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছি।
প্রকল্পটির তীর রক্ষার কাজটি করবে তারা (পানিসম্পদ বিভাগ)। ঘাট উন্নয়ন অ্যাপ্রোচ রোডসহ আনুষঙ্গিক কাজ হবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। প্রকল্পটির আনুমানিক ব্যয় সম্পর্কে জানতে চাইলে সচিব জানান, এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
আমরা ঘাটের পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে জানতে হাইড্রোলজিক্যাল ও ইকোলজিক্যাল (পরিবেশগত) প্রভাব সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছি। এজন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পের প্রাথমিক প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটকে আধুনিকায়ন করতে নানা পদক্ষেপ থাকছে। দুই পাশেই আধুনিক সুবিধা সংবলিত বহুতল টার্মিনাল ভবনসহ গড়ে তোলা হবে অন্যান্য স্থাপনা। নতুন ফেরিঘাট নির্মাণ, আরসিসি পার্কিং ইয়ার্ড, অভ্যন্তরীণ রোড এবং ফেরিঘাট অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ করা হবে।
ফেন্সি ওয়ালসহ ফেরিঘাটের কাছে প্রটেকশন ওয়ালের মাধ্যমে নদীর তীরও শক্তভাবে রক্ষা করা হবে। স্পাডসহ ফেরিঘাটে স্টিল জেটি নির্মাণ করা হবে। এগুলো ঘাট থেকে নদীর দিকে আড়াআড়ি থাকবে, যাতে শীত-বর্ষা সবসময় ফেরি ভিড়তে পারে। উভয় পাশেই উন্নতমানের ফোর লেন সংযোগ সড়ক থাকবে। উন্নত দেশের আদলে ফেরিঘাটে থাকবে ইকোপার্ক ও প্লে-গ্রাউন্ড
ঘাটে নৌ-যানগুলোর আগমন-নির্গমন ও ফেরিতে পারাপারের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রী এবং পরিবহনগুলোর জন্যও গড়ে তোলা হবে উন্নত টার্মিনাল ও পার্কিং সুবিধা। মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো জানায়, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথ রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এ নৌপথে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রীবাহী ও মালবাহী পরিবহন পারাপার করা হয়ে থাকে। তবে পদ্মার দুই পাড়ের ঘাটগুলোর অনুন্নত অবকাঠামো, নদী ভাঙনে ঘাটের আয়তন কমা, ফেরি স্বল্পতা, যানবাহনের আধিক্য, নদীতে নাব্য সংকট ও সংযোগ সড়কের বেহাল দশাসহ বিভিন্ন কারণে উভয় পাড়ে প্রতিদিন তৈরি হয় মারাত্মক যানজট। শত শত গাড়ি আটকে থাকে। বিশেষ করে দুই ঈদসহ অন্যান্য উৎসবে যানজট ভয়াবহ রূপ নেয় ব্যস্ততম ঘাটগুলোতে। কাঁচাপণ্য ও মালবাহী গাড়িগুলো দীর্ঘ সময় আটকে থাকার ফলে ভাড়া বেড়ে যায়। এটি নিত্যপণ্যের দামের ওপর প্রভাব ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে পণ্য পচে নষ্ট হয়ে যায়। উপরন্তু দীর্ঘ যানজটে যাত্রী ভোগান্তি এখন নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়।
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটটি এখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে পানি বাড়লে প্রচ স্রোতের কারণে ফেরি বন্ধ থাকে আবার পানি কমলে নাব্যতার অভাবেও ফেরি বন্ধ থাকে। গ্রীষ্মে ঝড় বৃষ্টিতে ফেরি বন্ধ, আবার শীতে কুয়াশাতেও ফেরি বন্ধ থাকে। এর ওপর নানা কারণে দুই পাশের ৬টি করে ১২টি ঘাটের মধ্যে চার থেকে পাঁচটি ঘাট বন্ধ থাকে। সূত্রগুলো জানায়, ধীরে ধীরে ফেরিঘাটগুলোর অবস্থা বেহাল হচ্ছে। তিন বছর আগে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের এক, দুই, তিন ও চার নম্বর ঘাটের দৈর্ঘ্য ছিল যথাক্রমে ৮৯০ ফুট, ৭১০ ফুট, ৩৮০ ফুট ও ১৭৫ ফুট। এর মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে চার নম্বর ঘাটটি। বর্তমানে অন্য তিনটি ঘাটের অ্যাপ্রোচ রোডের দৈর্ঘ্য হয়েছে যথাক্রমে ৫২৮ ফুট, ৩৮০ ফুট ও ২০০ ফুট। যেভাবে তীর ভাঙছে আর নাব্যতা কমছে তাতে কয়েক বছরের মধ্যে এই ঘাটগুলোও বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব অনল চন্দ্র দাস বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ফেরি পারাপারে দৈনন্দিন যে অব্যবস্থাপনা তা দূর হবে। নতুন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার পাটুরিয়া এবং রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া- উভয় ফেরিঘাটকেই ঢেলে সাজানো হবে। বিশেষ করে ঈদের সময় ফেরিঘাটে যে দুর্বিষহ যানজট তৈরি হয় সেটি আর থাকবে না। সারা বছরই ফেরিঘাট চালু থাকবে।