বর্ষণে বর্ষণে সিক্ত পিতার মুখ : কবি আবদুস সামাদ ফারুক

দ্বারা zime
০ মন্তব্য 314 দর্শন

 

বর্ষণে বর্ষণে সিক্ত পিতার মুখ: আবদুস সামাদ ফারুক

আব্বা এবং আম্মাকে নিয়ে কখনো লিখিনি। পৃথিবীর পথে পথে এই যে বিচরন তাতো তাদের জন্য।

আব্বার নাম মো. আবদুল আহাদ। জন্ম ২২/৪/১৯৩২ এবং মৃত্যু ২/৭/২০০৯। ১৮ আষাঢ় ১৪১৬ বংগাব্দ দিবাগত শেষ রাতে তিনি চলে গেলেন চিরদিনের জন্য।

আমার দাদা মাওলানা হাসমত উল্লাহ্ দেওবন্দী পৃথিবী থেকে চলে যান ২১ জুন ১৯৭৪ খ্রি, ৭ আষাঢ় ১৩৮১ বংগাব্দ, বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায়। আমার দাদী মোছা ছাহেরা খাতুন ৭ জুলাই ১৯৯৩ খ্রি, ২৩ আষাঢ় ১৪০০ বংগাব্দ।

আব্বার জন্মের পূর্বে আমার দাদা দাদীর ছয় জন পূত্র সন্তান জন্ম নিলেও কয়েক দিন বেঁচে ছিলেন তারা। দাদী বলতেন জ্বীনের সাথে ঝগড়া হয়েছিল তার। কালতি সময়ে কুয়া তলায় দাদী জীনের দিকে বদনা ছুঁড়ে মেরেছিলেন। তাই জ্বীন প্রতিশোধ নিয়েছেন। আব্বার জন্মের পর দাদার পীর হুজুর কেবলা সুফী মুফতী হযরত আযানগাছী (র) তাঁকে স্ত্রী ও পুত্র সহ কলকাতায় তাঁর ফকিরী হুজরা মোবারকে চলে যেতে বলেন। দাদা স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে নিয়ে কলকাতার বাগমারীতে বাসা নিলেন। দাদা হযরত আযানগাছী (র) এর আস্তানায় পবিত্র কোরআনের উপর ক্লাস নিতেন। দাদার সম্পর্কে এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে বলা সম্ভব হচ্ছে না।

আব্বার শৈশব ও স্কুল শুরু কলকাতায়। কলকাতার সংস্কৃতিতে তিনি মাতৃভাষার পাশাপাশি ফার্সি ও উর্দু ভাষায় কথা বলা রপ্ত করেন। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর হুজুর কেবলা তাঁর মুরীদদেরকে কে কোন দেশে যাবেন জানতে চান। দাদা জানান যে তিনি তার পিতৃভূমিতে ফিরে যেতে চান। দেশ ভাগের পর বহু বছর কলকাতার শিয়ালদহ থেকে ঢাকায় রেলগাড়ি চলেছে। দাদা চলে আসলেন সপরিবারে নালিতাবাড়ী। আব্বা ভর্তি হলেন তারাগঞ্জ হাই স্কুলে।

কলকাতার জীবন আব্বার স্মৃতিতে উজ্জল ছিল । ১৯৪৬ সালের দাংগা।হিন্দু মুসলমানের এই ঘৃন্য দাংগার সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। বিহারীরা ছিল ক্ষুব্ধ তারা সোহরাওয়ার্দীর গাড়ী আক্রমণ করতো। আব্বা সে স্মৃতি বলতেন। কলকাতার বাবুয়ানা কিছুটা তার মধ্যে ছিল। দেশে ফেরার পর পোশাকে আশাকে বিলাসিতা ছিল।

এক বাপের এক ছেলে। দাদার সংসার নিয়ে খুব ভাবনা ছিল না । আল্লাহর দিকে নিবেদিত মানুষ।দাদী হচ্ছেন খুব সংসারী। মেট্রিক পর্যন্ত পড়ালেখার পর আব্বা বিয়ে করলেন। আম্মার নাম হাসনারা বেগম। নানা মো. বদিউজ্জামন খান, নানী ফিরোজা বেগম, গৌড়দ্বার , নকলা।

আব্বা সংসারের নির্মান শুরু করলেন। বাবুগিরি চলে গেল। জমি জমা, গৃহস্থালী নিয়ে উদয়াস্ত জীবন সংগ্রাম এবং সফলতা অর্জন। অনেকেরই আদর্শ।

শিশুবেলায় আব্বা গণিত শিখিয়ে দিতেন। গণিতে আমি নিরানব্বই পর্যন্ত পেয়েছি ।

১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাসে আব্বার সাথে তারাগঞ্জ হাইস্কুলে ভর্তি হতে যাই। শিক্ষা গুরু নগেন স্যার ও লালুবাবু স্যারের সাথে দেখা হয়। নগেন স্যার আব্বারও শিক্ষক। সস্নেহে আব্বাকে বসালেন।

আমি অতি শৈশবে দাদীর সাথে থাকতাম। আমি তখন দাদীর রাতের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রাত যতো গভীর হয় তালের পাখার বাতাসে কিংবা লেপের উষ্ণতায় অনন্য বয়ান শুরু হয়। কোন প্রশ্ন নেই মুগ্ধতায় শুধু শোনা। কলকাতার জীবন,হুজুর কেবলার শুধু ছোলা খেয়ে জীবন ধারন, হাওড়া, হুগলী, মেদেনীপুরের পীর, বোনদের কথা, দাদীর মার কথা, দুই বড় ভাই নকলার লয়খা গ্রামের খোশ মামুদ তালুকদার এবং আলী হোসেন তালুকদারের কথা। প্রপিতামহ তরীপ মন্ডল ও দাদী তার শ্বাশুড়ীর কথা বলতেন। কিসসার মতো কথা, চলতে থাকে কথামালা, শেষ হয়না। আর শুধু হাহাকার , দুংখবোধ, চোখের পানি ঝরা।

প্রতিটি রাত যেন মায়াবী পর্দা খুলে দিতো আমার শিশু মনে। অসম্ভব বুদ্ধিমতী এবং বিষয়জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ ছিলেন দাদী। তার হাতের রান্না পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রান্না। তবে বলে রাখি আমার দাদী এবং আব্বা একজন আরেকজনকে তুই বলে ডাকতেন। আব্বা ডাকতেন মা বলে, আম্মা বলে নয়। দাদাকে আব্বাজান বলতেন।

আমি ২০০১ -২০০৩ সাল পর্যন্ত ইউএনও বিশ্বম্ভরপুর সুনামগঞ্জ। আব্বার পায়ে ঘায়ের মতো, ব্যথায় প্রচন্ড চিৎকার। আমার স্ত্রী এই অবস্থা দেখে ঢাকায় নিয়ে এসে বারডেমে ভর্তি করলেন। ইউএনও ও ডিসির চাকরী সবচেয়ে কঠিন চাকরী। কোন ছুটি নেই। দুই দিনের ছুটি নিয়ে বারডেমে গেলাম। আব্বা ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। তিন মাস ধরে চিকিৎসা দিয়ে ডায়াব্টিকস নামাতে পারছে না। বারডেমের চিকিৎসা সেবার ধরন দেখে হতাশ হলাম। খুব অসহায় মনে হলো নিজেকে। কতো মানুষের জন্য কতো কিছু করলাম। অথচ আব্বার জন্য কিছুই করতে পারছি না।

বারডেম কিছু করতে পারলো না। বেংগল ক্লিনিকে ভর্তি করলাম। আব্বার পায়ের তিনটি আংগুল কেটে ফেলা হলো। অনেক কষ্টে ঘা শুকাল। বাড়ী ফিরে গেলেন। জীবনে কোনদিন হাসপাতালে ভর্তি হননি।এরপর আব্বা কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন, সংসারী আমার ছোট ভাইকে দিলেন।কিছুই খেতে সাহস করেন না।

২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে সাতক্ষীরায় জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদে আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়। যোগদান করতে কিছুটা সময় নেই। আব্বা ও আম্মার সাথে দেখা করে দোয়া নেই। ১লা বৈশাখের পর যোগদান করি। ২৫ মে’র আইলা সাতক্ষীরাকে বিধ্বস্ত করে ফেলে। আমার দম ফেলার সময় রইলো না। আব্বা ফোন করে আমার খোঁজ খবর নিলেন। আইলা বিধ্বস্ত মানুষের সেবা দিতে বললেন।

১লা জুলাই ২০০৯ ঢাকায় এসেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। রাতের শেষ ভাগে ফোন আসলো। আমি বুঝে গেলাম আব্বা নেই। পরদিন সপরিবারে বাসে চড়ে নালিতাবাড়ী। বাস যখন ছাড়লো চোখের বর্ষন তখন বাইরের বর্ষনের সাথে মিশে গেছে ।

এক নির্লোভ, নিরাহংকারী মানুষ তিনি। নিভৃতচারী। কার্তিক মাসে প্রতি বছর খাদ্য সংকট দেখা দিতো। অনাহারী মানুষকে খাদ্য দিয়ে সহায়তা করতেন তিনি।

আজকের মতো এক বর্ষনমুখর সময়ে চলে গেলেন। বর্ষার সাথেই তার জীবন কাব্য। সবুজ ফসল, শস্য দানা আর দিগন্ত রেখা ছোঁয়া এমন বর্ষায় তার মাতামাতি শ্যমল ধরিত্রী সৃষ্টির জন্য।

আজ বর্ষা যখন নামছে পৃথিবী কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কোলাহল নেই। কোথায় কেউ নেই। অসীম শূন্যতা। আব্বাকে মনে পড়ছে। আপনজনদেরকে মনে পড়ছে। আল্লাহ সোবাহানাতালা এই মানুষদের যেন ভাল রাখেন।

বর্ষণে বর্ষণে সিক্ত এই মানুষদের মুখ যেন বর্ষার মতোই পুণ্যময় পবিত্র হয়ে ভাসছে।

লেখক:
আবদুস সামাদ ফারুক
চেয়ারম্যান, সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এসডিএফ)
জ্যেষ্ঠ সচিব (অবঃ) নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।





০ মন্তব্য

আরও পোস্ট পড়ুন

মতামত দিন