খুলনার উপকূলীয় এলাকার উপজেলাগুলোর ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের ঢল নেমেছে। প্রবল শক্তিশালী ‘ফণী’র ছোবল থেকে বাঁচতে ঘরবাড়ি ছেড়ে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন সেখানে। আবহাওয়ার অবনতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে থাকেন মানুষ। শুক্রবার দুপুরের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে দেখা যায় মানুষের ভিড়। আবহাওয়া অফিস বলছে, মধ্যরাত নাগাদ ফণী খুলনা অতিক্রম করতে পারে।
তবে আশ্রয়কেন্দ্রে যাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের জন্য খাবারের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। আবার সেখানে রান্নার সুবিধা না থাকায় কিছু রান্না করেও খেতে পারছে না মানুষ। ক্ষুধা নিবারণের জন্য সঙ্গে থাকা শুকনো খাবারই তাঁদের ভরসা।
ঘূর্ণিঝড় ফণীর জন্য খুলনার তিনটি উপজেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে জেলা প্রশাসন। এই তিনটি উপজেলা হলো কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ। উপকূলীয় এলাকার ওই তিনটি উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ বেশি আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে শুক্রবার দুপুর থেকে খুলনায় ঝড়–বৃষ্টি শুরু হয়। সকালে রোদ থাকলেও বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ অন্ধকার হতে থাকে। ধীরে ধীরে পুরো আকাশ ছেয়ে যায় কালো মেঘে। বেলা দেড়টার দিকে হালকা দমকা বাতাসের সঙ্গে শুরু হয় বৃষ্টি। হালকা বাতাসের সঙ্গে থেমে থেমে চলতে থাকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি।
খুলনা আবহাওয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, দুপুরের দিকে ফণী ঘূর্ণিঝড়টি মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দক্ষিণ–পশ্চিমে অবস্থান করছিল। মধ্যরাত নাগাদ এটা খুলনার উপকূল এলাকা অতিক্রম করতে পারে।
কয়রা ও দাকোপের কয়েকটি এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকাল থেকেই মাইকে বারবার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছিল। কিন্তু মেঘমুক্ত আবহাওয়া থাকায় কেউ তা গুরুত্ব দেয়নি। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কালো মেঘের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক তৈরি হয়। বিশেষ করে দুপুরের দিকে ঝোড়ো বাতাস ও বৃষ্টি হওয়ার পর মানুষ বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এরপর আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে।
ফণীর ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক মাইকিং করা হচ্ছিল। এ সময় মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি এলাকা ভিত্তিতে ওই প্রচারণার কাজটি করে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবককে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ—এই তিন উপজেলার নদীগুলোতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানির উচ্চতা কয়েক ফুট বেড়ে গেছে। অনেক এলাকায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট এলাকার চেয়ারম্যানদের নিয়ে বাঁধ সংস্কারের চেষ্টা করেন।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা-২–এর নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জি প্রথম আলোকে বলেন, কয়রা, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা ও দাকোপ উপজেলার অন্তত ১০টি জায়গা ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। ওই সব জায়গায় ভাঙন প্রতিরোধে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সিমেন্টের প্লাস্টিকের বস্তার মধ্যে বালু ভরে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে ফেলা হচ্ছে। মধ্যরাতে ফণী যখন খুলনায় আঘাত হানবে তখনো নদীতে থাকবে জোয়ার। ওই সময় যদি কোনো অঘটন না ঘটে, তাহলে আর সমস্যা হবে না।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিমুল কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, সকাল থেকেই আবহাওয়া ভালো ছিল। এ কারণে অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি। তবে আবহাওয়া খারাপ হওয়ার পর থেকেই আতঙ্কিত মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটছেন। গতকাল রাতে অবশ্য কিছু বয়স্ক মানুষ ও গর্ভবতী নারীরা আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। সকাল থেকে এলাকায় আবারও মাইকিং করা হচ্ছে এবং মানুষকে জোর করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
দাকোপ উপজেলার নিয়ন্ত্রণকক্ষের দায়িত্বরত কর্মকর্তা মো. আবদুল কাদের বলেন, নদীর জোয়ারের পানি বেড়ে যাওয়ায় বানীশান্তা এলাকায় বাঁধ ছাপিয়ে নদীর কিছু পানি লোকালয়ে প্রবেশ করলেও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিয়ে তা মেরামত করা হয়েছে।
পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুলিয়া সুকায়না প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের জন্য আগে থেকেই এলাকায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। দুটি এলাকায় নদীভাঙনের প্রবণতা দেখা দিলে পাউবো ও স্থানীয় মানুষের সহায়তায় তা সংস্কারের কাজ করা হয়েছে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর মানুষ কিছুটা ভয় পেয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটছেন। ঝড়ের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতা চালানোর জন্য প্রায় এক হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।
বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা
এবার বোরো মৌসুমের শুরুতে টানা কয়েক দিনের বৃষ্টির ফলে খুলনায় ধানের বাম্পার ফলন হয়েছিল। তবে কৃষকের মুখের সেই হাসি মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। জমিতে পাকা ধান রেখেই জীবন বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে হচ্ছে তাঁদের।
ঝড়ের পূর্বাভাসের জন্য ধানের ৮০ শতাংশ পাক ধরলেই তা কেটে ফেলেছেন কৃষকেরা। তবে বটিয়াঘাটা ও কয়রা এলাকার বিস্তীর্ণ এলাকার ধান এখনো রয়ে গেছে। আজ শুক্রবার বিকেল পর্যন্তও অনেকে ধান কাটার কাজ করছেন।
কয়রা মহারাজপুর এলাকার মোহাম্মদ আলী নামের এক কৃষক জানান, এবার প্রায় ৯ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন তিনি। ঝোড়ো আবহাওয়ার পূর্বাভাসের কারণে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ধান পেকে যাওয়ার আগেই তিন বিঘা জমির ধান কেটে ফেলা গেছে। আরও এক সপ্তাহ সময় পেলে বাকি ফসলটুকুও ঘরে তোলা যেত।
বটিয়াঘাটা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলার ৪ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। বিকেল পর্যন্তও অনেক কৃষক ধান কাটার কাজ করেছেন।
খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপপরিচালক পঙ্কজ কান্তি মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, এবার খুলনা জেলায় ৫৯ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৭১ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। যেসব এলাকায় দেরিতে ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে, সেসব এলাকায় ধান কাটা হয়নি।
সূত্র: প্রথম আলো নেট।