সখিনা বেগম, স্বামী দিনমজুর। অভাবের সংসারে এক মেয়ের খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। এরপর আবার গর্ভবতী হলে আল্লাহর নিকট অনেক কান্নাকাটি করেছেন, এবার যেন একটি ছেলে হয়। আর কোন সন্তান নিতে চাননা তারা। হ্যাঁ, কোলজুড়ে এসেছিল একটি সন্তান তার। তবে পুত্র নয় কন্যা সন্তান। তবুও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নিয়েছিলেন জীবনের চরম সিদ্ধান্ত। লাইগেশন করে আর কোন সন্তান নিবেন না বলে মনস্থির করেছিলেন। সন্তান জন্মের সময় তাদের সিদ্ধান্তে সেটাই কার্যকর করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। সর্বসাকুল্যে মেরী স্টোপ ক্লিনিকের বিল আসে দশ হাজার। তবে লাইগেশন করায় তিন হাজার টাকা ছাড় পান। গরীব দিনমজুর স্বামীর পক্ষে সাত হাজার টাকা বিল দেয়া ছিল অসম্ভব। অনেক কষ্টে তার মা পাঁচ হাজার টাকা সংগ্রহ করে হাসপাতালে জমা দিলেও ছাড় পাননি হাসপাতাল থেকে। এমন পরিস্থিতীতে কোলের শিশু সন্তানটি তিনদিন বয়সে ক্লিনিক থেকেই হয়ে যায় চুরি। দিশেহারা সখিনা বেগম ও তার দরিদ্র পরিবার। সন্তানের শোকে বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন।
ঘটনা নরসিংদী সদরের বাসাইল এলাকার মেরী স্টোপ ক্লিনিকে। গত ১০ নভেম্বর বাচ্চা প্রসবের জন্য ভোর রাতে ছুটে যান নরসিংদী সদর হাসপাতালে। কিন্তু সেদিন সরকারী বন্ধ থাকায় হাসপাতালে গাইনী বিভাগের কোন চিকিৎসক ছিল না। বাধ্য হয়ে দরিদ্র দম্পতি আশ্রয় নেন মেরী স্টোপ ক্লিনিকে। তখন সকাল সাতটা। হাসপাতালে ভর্তির পর সাতটা পয়ত্রিশ মিনিটে প্রসব করেন এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান। একইসাথে হয় লাইগেশন। সুস্থ্য হয়ে ১৩ নভেম্বর হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেয়ার অপেক্ষায় সখিনা বেগম। কিন্তু হাসপাতালে বিল মেটাতে না পেরে হাসপাতালেই ছিলেন শিশু সন্তানসহ। দুপুর একটার দিকে সখিনার নিকট আসেন এক অপরিচিত মহিলা। কথায় কথায় সাহয্যের হাত বাড়ান সেই মহিলা। অল্প সময়েই অনেকটা আপন হয়ে যায় সে। দুপুরের খাবার এনেও খাওয়ান তিনি পরম যত্নে। স্বামী ও স্বজনরা হাসপাতালের বিল যোগাড় করতে ব্যস্ত বাইরে। বিকাল চারটার দিকে সখিনা ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে আর খুঁজে পায়না তার শিশু সন্তানসহ সেই অপরিচিত মহিলাকে। কান্নার রোল পড়ে যায় হাসপাতালে। আর কখনও মা হতে পারবেন না সখিনা বেগম। হাসপাতালে বিল ছাড়াও যেতে দিবে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বরং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করেন বিল না দিতেই এ ফন্দি করেছেন সখিনা ও তার পরিবার।
খবর পৌঁছে যায় নরসিংদী সদর থানায়। ছুটে আসেন ওসি সাহেবসহ অন্যান্য অফিসাররা। সব শুনে আশপাশে চেকপোস্ট বসিয়েও উদ্ধার করতে পারেননি সেদিন। অপরিচিত মহিলার কোন ঠিকানা বা ছবি নেই কারও কাছে। হাসপাতালে নেই কোন সিসি ক্যামেরা। হাসপাতালের বাইরে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ করে বিকাল চারটা পাঁচ মিনিটের সময় দূর থেকে দেখা যায় এক মহিলা কোলে বাচ্চা নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার দৃশ্য। তবে সে ছবি স্পষ্ট নয়। তথ্য প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে চলে অপরিচিত মহিলাকে অনুসন্ধানের কাজ। শিবপুর থানাধীন কুমড়াদি এলাকার দরিদ্র সখিনা ও তার স্বামী শাহ আলম শিশু সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। নরসিংদী সদর মডেল থানায় মানব পাচার আইনে মামলা রুজু করে তদন্তভার দেয়া এসআই মোঃ ইমরান হোসেনকে। অবশেষে ১৯ নভেম্বর নরসিংদী রেলস্টেশন এলাকা থেকে আটক করা হয় সেই অপরিচিত মহিলা ইয়াসমিন(২৫) কে। উদ্ধার করা হয় সখিনা বেগম ও শাহ আলম দম্পতির যক্ষের ধন চুরি হওয়া শিশু কন্যাকে। আটককৃত আসামি ইয়াসমিনকে জেলখানায় প্রেরণ করা হয়েছে বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে। শিশু সন্তানটিকে বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে জিম্মায় দেয়া হয়েছে তার বাবা মায়ের হেফাজতে। দরিদ্র সখিনা ও শাহ আলম পরিবারে থেমে গেছে কান্না আর আর্তনাদের। পুলিশের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তারা বারবার সৃষ্টিকর্তার নিকট হাত তুলে দোয়া করছেন পুলিশের জন্য। বারবার উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলছেন “যাদের কেউ নেই তাদের আছে আল্লাহ এবং পুলিশ”। ধন্যবাদ তদন্ত সংশ্লিষ্ট টিমকে।
তথ্য সংগ্রহ ও লেখা- হাফিজুর রহমান
উপ-পুলিশ পরিদর্শক, ঢাকা রেঞ্জ মিডিয়া।
ইনসেটে- উদ্ধারকৃত শিশুসহ বাবা-মা