যৌনপল্লীর শত শত শিশুকে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে ‘উত্তরণ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন। আর এই উদ্যোগটা এসেছে যার হাত ধরে তিনি একজন পুলিশ কর্মকর্তা। ঢাকা রেঞ্জ অফিসে কর্মরত, উপমহাপরিদর্শক বা ডিআইজি হিসেবে। নাম হাবিবুর রহমান বিপিএম(বার) পিপিএম(বার)।
সমাজের পিছিয়ে পড়া বেদে সম্প্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় উঠিয়ে আনা ডিআইজি হাবিবুর রহমানের উত্তরণ ফাউন্ডেশন এবার যৌনপল্লীর শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করেছে। দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লী রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায় , যা এখন দৌলতদিয়া পূর্বপাড়া নামে পরিচিত। এখানে রয়েছে এক হাজার ৩০০ যৌনকর্মী ও তাদের পরিবারের তিন শতাধিক শিশু। এসব শিশুকে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনাই উত্তরণ ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য।
এ বছরের শুরুতে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায় বহু পুরনো যৌনপল্লীতে প্রথমবারের মতো একজন যৌনকর্মীর পুরোপুরি ইসলামি প্রথা মেনে জানাজা পড়িয়ে দাফন করা হয়। পরে চেহলামেরও আয়োজন করা হয়। এসব উদ্যোগের নেতৃত্ব দেন মানবিক পুলিশ হিসেবে সুনাম পাওয়া ডিআইজি হাবিবুর রহমান।
২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সাভার থেকে শুরু হয় উত্তরণ ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম। বর্তমানে সাভার ছাড়াও মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নাটোরের সিংড়া এলাকার বেদে ও হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে কাজ করছে সংগঠনটি।
মানবিক পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমানের ভূমিকার কারণে বেদে এবং হিজড়া জনগোষ্ঠীর অনেকের সামাজিক অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে; এখন নতুনভাবে দৌলতদিয়ার যৌনপল্লীর শিশুদের জন্য কাজ শুরু করেছেন তিনি।
সমাজের পিছিয়ে পড়া এই শিশুদের তুলে এনে মূলধারায় ফেরানোর চেষ্টা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘হ্যাঁ, বলতে পারেন। তাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি। এখনও যে করেছি সেটা বলা যাবে না। বিশেষ করে যৌনকর্মীদের সন্তানদের জন্য খারাপ লাগে। দৌলতদিয়া, যেখানে তাদের মা থাকে, তাদের তো বাবা নেই। ওরা তো বোঝেই না বাবা কি! কারণ থাকে মায়ের সঙ্গে।’
‘এই শিশুরা বড় হচ্ছে আর দেখছে তার মা প্রতিদিন একেকজনকে নিয়ে ঘরের দরজা আটকাচ্ছে। এটা তাদের মনের ওপর বড় ধরনের রেখাপাত করে। শিশুরা এসব দেখে দেখে বড় হয়ে ওঠে। ফলে তার ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তার মনের ভিতরে সমাজের প্রতি ঘৃণা, ক্ষোভ জন্মায়। ফলে এই শিশুরা পরবর্তী জীবনে কিন্তু স্বাভাবিক মানুষ হয়ে ওঠার কথা না।’
যৌনপল্লী থেকে শিশুদের আলাদা রাখার চেষ্টা করছে উত্তরণ ফাউন্ডেশন। মায়েরা মাসের নির্দিষ্ট সময় তার সন্তানকে দেখতে যেতে পারবে। তাহলে শিশুদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। এই শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে শিক্ষা উপকরণ যেমন স্কুলব্যাগ, খাতা-বই-কলম, টিফিন বক্স, দুধের ফিডারসহ নানা ধরনের উপকরণ তুলে দেওয়া হয়।
ডিআইজি হাবিব বলেন, ‘যৌনপল্লীর শিশুদের কিন্তু স্বাভাবিকভাবে সামাজিক চিন্তা-ধারণা থাকে না। তারা কিন্তু সামাজিক মানুষ হয় না। এজন্য আমরা চেষ্টা করছি বাচ্চাদের একটু সেইভ সাইটে রেখে কিছু করা যায় কি না। তারা আলাদা জায়গায় থাকবে। প্রয়োজনে তার মা গিয়ে দেখা করে আসবে। এ ধরনের কিছু একটা করা যায় কি না সেটাই করার চেষ্টা করছি।’
‘করোনা মহামারির এই সময়ে তাদেরকে আমরা খাবার দিয়েছি, রোজার ঈদে খাবার দিয়েছি। গত ঈদের সময়ে তাদের কাপড় দিয়েছি, ঈদের বাজার করে দিয়েছি। আবার এই ঈদেও তাদেরকে গরুর মাংস দিয়েছি। তারা তো সহজে গরুর মাংস পায় না। কোরবানির সময়ে কোরবানির মাংস তো তারা পায় না। এছাড়াও অসহায় দুই হাজার নারীকে ১ কেজি করে কোরবানির মাংস বিতরণ করা হয়েছে।’
১৯৬৭ সালে গোপালগঞ্জের চন্দ্র দিঘলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হাবিবুর রহমান। ১৭তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে তিনি সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে যোগ দেন। কর্মক্ষেত্রে সততা, সাহসিকতা, দক্ষতা আর সময়োপযোগী ও দূরদর্শী নেতৃত্বগুণের কারণে এরই মধ্যে সুখ্যাতি পেয়েছেন তিনি। তিনবার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) ও দুইবার রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পেয়েছেন।
সেবা, সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য পুলিশ সপ্তাহে পদক দেওয়া হয় যা বিপিএম এবং পিপিএম নামে পরিচিত। প্রথমটি বাংলাদেশ পুলিশ পদক এবং পরেরটি রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক। পেশাগত কাজের বাইরে তিনি একজন ক্রীড়া সংগঠকও। বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন সেক্রেটারি এবং এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশনের সহ-সভাপতি এই পুলিশ কর্মকর্তা।
যৌনপল্লীর শিশুরা যাতে সামাজিক মানুষ হতে পারে সেজন্য কাজ করছেন জানিয়ে ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘যৌনপল্লীর মানুষেরা সামাজিক ও ধর্মীয় বঞ্চনার শিকার হতো। তাদের মৃত্যুর পর জানাজার নামাজ পড়া হতো না। মৃত্যুর পর তাদেরকে কবর দিতে বাধা দেওয়া হতো, পানিতে ভাসিয়ে দেওয়ার প্রথা ছিল। এখন কেউ মারা গেলে স্বাভাবিকভাবে দাফন করা হচ্ছে। পানিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে না, জানাজা দেওয়া হচ্ছে। আর অন্য ধর্মের হলেও তাদের ধর্মীয় নিয়ম মেনে সৎকার করা হচ্ছে। তারা ঈদের সময়ে কোরবানি ঈদের মাংস পেতো না, সেটাও আমরা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এছাড়া বাচ্চাদের আলাদা করে তাদের পড়াশোনা করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’
সমাজের প্রতিটি পেশারই স্বাধীনতা আছে। দৌলতদিয়ার বাসিন্দারা শরীর খাটিয়ে জীবন ও জীবিকার জন্য অর্থ আয় করে। সেই অর্থে একদল সুযোগসন্ধানী এতদিন ভাগ বসিয়ে আসছিল। বর্তমানে কেউ যাতে তাদের আয়ের অর্থ ছিনিয়ে না নিতে পারে, সেজন্য পুলিশ নজর রাখছে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক কেউ যাতে এ পেশায় না আসে এবং কাউকে ফাঁদে ফেলে জোর করে এ পেশায় না রাখে সেজন্যও নজরদারি আছে।
হিজড়া ও বেদে সম্প্রদায়ের জীবনমান বাড়াতে উত্তরণ ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘রাজবাড়ীতে হিজড়াদের গরুর খামার করে দেওয়া হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাইবান্ধা, নওগাঁয় হাঁসের খামার করে দেওয়া হচ্ছে, ঢাকার মধ্যে একটি পার্লার উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে।’
‘এছাড়া গাজীপুর ও আশুলিয়ায় একটি করে পার্লার করে দেওয়া হয়েছে। যেখানে আমরা চেষ্টা করছি তাদেরকে কর্মের আওতায় আনার। তাদেরকে কর্মের মধ্যে আনতে পারলে তারা রাস্তায় যাওয়ার যে অভ্যাস, সেটা বন্ধ হবে বলে মনে করি।’
সংবাদ ঢাকা টাইম্স এর।