শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: নৃশংস হত্যাকাণ্ডের এক নজিরবিহীন দলিল” তরিকুল ইসলাম প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন
একটি জাতির শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়ার জন্য সে জাতির শিক্ষিত সমাজ ধ্বংস করাই যথেষ্ট। জাতিটি ধুঁকে ধুঁকে সহসাই মৃত্যুপথে ধাবিত হবে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পরই আইয়ুব সরকার কিংবা পাক-শোষকবর্গ স্পষ্টই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন; বাঙালিকে খুব বেশিদিন করায়ত্তে রেখে রক্ত শোষণ করা যাবে না। যতটুকু রক্ত পান করা হয়েছে সেটারও জবাব দিতে হতে পারে। এই ভাবনা রেখেই সত্তুর এর নির্বাচনের ক্ষমতা হস্তান্তর বিলম্ব ও বঙ্গবন্ধুর সাথে ইয়াহিয়ার জরুরি বৈঠকের ছলনায় পর্দার আড়ালে গণহত্যার ভয়ংকর ছক। একাত্তরের ২৫ শে মার্চের সেই আঘাত কোনো প্রকারে সহ্য করে বিজয়ের প্রায় সন্নিকটে এসে মেধাশূন্য করার প্রয়াস, আহ! কী বিভৎস। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব-এর বিপরীত দিকটি আয়নায় উলটো প্রতিচ্ছবি দেখা ছাড়াই বলা যায়। ১৪ ডিসেম্বরের সেই দিনটি পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে ।
আজ সেই ১৪ই ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় দিন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে বেদনাবিধুর দিন। সারাদেশের মানুষ আজ বেদনাসিক্ত অশ্রু-শ্রদ্ধায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করবে। লেখার শুরুতেই আমি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি সকল শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি এবং তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসর বিশ্বাসঘাতক স্বাধীনতাবিরোধী চক্র–জামাত, আল বদর, আল শামস, রাজাকারদের নজিরবিহীন নৃশংসতা এবং এক ভয়ংকর নীলনকশা বাস্তবায়নের একটি প্রামাণ্য দলিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বাহ্নেই শোষক পাকিস্তানী প্রশাসন বুঝতে পেরেছিল এদেশের সহজ-সরল মানুষগুলোকে আর শাসন-শোষন করা যাবেনা। বাংগালী জেগে উঠেছে। এদেশে পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের পতন অনিবার্য। এটা কেবল কিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই পরাজয়কে সহজে মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। কি করেইবা হবে? সুজলা -সুফলা এই দেশটিকে শোষণ করেই যে তাদের সমৃদ্ধি। বাংগালীর এই জাগরণে এদেশের সূর্য -সন্তান বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল আলোকবর্তিকার। ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংগালীদের দমিয়ে রাখার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের যে কোন হীন-চক্রান্তের বিরুদ্ধে তাঁরা বারবার সোচ্চার হয়ে উঠেছেন, যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।
পাকিস্তানীরা যেহেতু বুঝতে পেরেছিল এদেশে তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে তারা এদেশের মানুষকে একটা মরণ কাঁমড় দেবার জন্য মরীয়া হয়ে উঠে।তাদের এই কুৎসিত ইচ্ছায় আরো ইন্ধন যোগায় এদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দালালচক্র। এই স্বাধীনতাবিরোধী, দেশের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা দালালগুলো বুঝতে পেরেছিল এতদিন পাকিস্তানী প্রভুদের পা চাটার, তাদের সাথে হাত মিলিয়ে হত্যা-ধর্ষণ-লুঠতরাজের যে জঘন্য ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে তার ফলশ্রুতিতে এদেশের মাটিতে বসবাস করা তাদের জন্যও অসম্ভব হয়ে উঠবে। কাজেই ঘাতক-দালাল চক্রের একটাই উদ্দেশ্য যেভাবে যতটুকু সম্ভব এদেশের ক্ষতি করা। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির যে কোন বিপর্যয়ে অগ্রনী ভূমিকা নিয়ে সমস্যা সমাধানের পন্থা নির্ধারণ করার যোগ্যতাসম্পন্ন ধীমান ব্যক্তিবর্গ তাদের এই ধবংস-প্রক্রিয়ার প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হন। এদেশকে মেধাশূন্য করে পঙ্গু করে ফেলার এক ভয়াবহ নীলনকশার পরিকল্পনা করে তারা। যার ফল হবে এদেশের মানুষের জন্য মারাত্মক এবং সুদূরপ্রসারী। কোন জাতির অগ্রসরমানতা বা সার্বিক বিকাশের ধারাকে প্রতিহত করতে এর থেকে মোক্ষম অস্ত্র আর কি হতে পারে?
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একদিকে নিজেদের পরাজয় নিশ্চিত, অন্যদিকে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের পর চার দিকে যখন বিজয়ের রব, মুক্ত পরিবেশে মানুষ যখন রাস্তায় বের হয়ে আসতে শুরু করেছে, ঘরে ফিরতে শুরু করেছে, বিজয়কে বরণের আনন্দে দুলছে ঠিক তখনই বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। বাঙালি যেন আর কোনোদিন বিশ্ব সভায় শিক্ষা, মননে, জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের এই নীল নকশাটি বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের আগ মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরকে বেছে নেয়।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয় বাঙালি জাতি। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আত্মদান ও দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পরিক্রমায় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। নিরস্ত্র বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত করার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি এদেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুজিবনগর সরকার গঠন, বিভিন্ন এলাকাকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করে সেক্টর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব প্রদান, বাংলাদেশের প্রথম সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও এসব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ব্যক্তিদের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাম্প্রদায়িকতা, উন্মত্ততা ও বর্বর গণহত্যার চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে বুদ্ধিজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের কালো রাত্রিতে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক বাঙালির উপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু হলে ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের আপামর জনতার সাথে বুদ্ধিজীবীরাও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু করেন। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুজিবনগর সরকার গঠন, বিভিন্ন এলাকাকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করে সেক্টর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব প্রদান, বাংলাদেশের প্রথম সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও এসব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ব্যক্তিদের দায়িত্ব প্রদান এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে বুদ্ধিজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মূলতঃ বুদ্ধিজীবীরা দেশ ও জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির রূপকার। তারা জাতির বিবেক। তাঁদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড, উদার ও গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা জাতীয় অগ্রগতির সহায়ক। ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি, যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারকে পরামর্শ প্রদানসহ বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিতে বিপুল অবদান রাখেন তাঁরা।
বীর বাঙালির সাহস ও মেধার কাছে যখন একে একে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প, আস্তানা নিশ্চিহ্ন হতে লাগলো, শত্রুবাহিনী একে একে পরাস্ত হয়ে যখন আত্মসমর্পণ করতে লাগলো, তখনই বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এদেশের রাজাকারদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাংলাদেশকে চিরদিনের জন্য মেধাশূন্য করার অপচেষ্টায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঠিক দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বাধীন বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
যুদ্ধকালীন সমস্ত সময় জুড়েই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হলেও ১৪ই ডিসেম্বরের মতো একসাথে এত বুদ্ধিজীবীকে এর আগে হত্যা করা হয়নি ,এজন্যই এই দিনটিকেই “শহীদ বুদ্ধীজীবী দিবস” রূপে পালন করা হয়। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ১৪ই ডিসেম্বরকে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস” বলে ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃঢ় নেতৃত্বে ’৭১-এর স্বাধীনতা বিরোধী ও ১৪ ডিসেম্বরের কলঙ্কজনক বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী শীর্ষ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধী রাজাকারের বিচার কার্য সম্পন্ন ও রায় কার্যকর হয়েছে। আর এটা কেবলমাত্রই সম্ভব হয়েছে বাঙালী জাতির অহংকার যিনি মৃত্যুর মিছিলে দাঁড়িয়ে জীবনের জয়গান গেয়েছেন, ধ্বংসস্তুপের উপরে দাঁড়িয়ে বারে বারে সৃষ্টির পতাকা উড়িয়েছেন। বারবার মৃত্যুর উপত্যকা থেকে ফিরে এসেও মৃতুঞ্জয়ী নেত্রী শেখ হাসিনা বিচলিত ও দ্বিধান্বিত হননি , বরং আরো দীপ্তপদভারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বিচারের রায় কার্যকর করার মাধ্যমে জাতিকে কলংকমুক্ত করার কাফেলাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
আজকের এই দিনে আমরা জাতির এই মহান সন্তানদের শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করি। কিন্তু যাঁরা নিজেদের জ্ঞান-মনীষা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জাতিকে পথ দেখিয়েছেন, তাঁদের কে স্মরণ করার জন্য বছরের একটা দিন যথেষ্ট নয়। আমাদের অনুধাবন করতে হবে, কেন এই মহৎপ্রাণ মানুষগুলো জীবন দিয়েছিলেন। বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে আজ যে দিবস পালিত হচ্ছে, তা সার্থক হবে, যদি আমরা তাঁদের উদার মানবিক চিন্তা ও আদর্শকে ধারণ করতে পারি। তাঁরা যে উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই পথ ধরেই বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তাঁদের আদর্শ হোক আমাদের পাথেয়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রেখে যাওয়া আদর্শ ও পথকে অনুসরণ করে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সমাজ গড়তে পারলেই তাদের আত্মত্যাগ স্বার্থক হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
লেখক : আ,ন,ম তরিকুল ইসলাম,প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা,ঢাকা উত্তর সিটি কর্পারেশন।