শরীফুল্লাহ কায়সার:
সাতক্ষীরাবাসীকে সাথে নিয়ে উপজেলার প্রতিটি ইঊনিয়নে পানিতে ডোবা প্রতিরোধে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। নদী খাল পুকুরের বাংলাদেশে পানিতে ডুবে মৃত্যু কখনই কাম্য হতে পারে না। তারমধ্যে সব থেকে পানিতে ডুবে
মৃত্যুর খবরের অধিকাংশই হলো শিশু ও শিক্ষার্থীরা। সুতরাং পানিতে ডোবা প্রতিরোধে প্রথম পদক্ষেপ হলো সাতার শেখা। সেই সাতার শেখার কাজটি সাতক্ষীরাবাসীকে সাথে নিয়ে উপজেলা পরিষদ শুরু করবে। এমন বার্তা দিলেন
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু।

চেয়ারম্যান বাবু বলেন এই গুরুত্বপূর্ণ দিবসটির প্রস্তাবক যেহেতু বাংলাদেশ সেহেতু পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে সরকার আজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সরকারের সাথে সাথে দেশের প্রতিটি মানুষকে আন্তরিক হয়ে বিশ্বের কাছে প্রমান করতে
হবে আমরা পেরেছি আমরা পারি।

সাতক্ষীরায় পানিতে ডোবা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক দিবসে পালনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন তিনি। ‘২৫ জুলাই পানিতে ডোবা প্রতিরোধ দিবস, সাতক্ষীরা’ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে। শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমির সামনে থেকে অনলাইন আলোচনা সভা ও পানিতে ডুবে মৃতদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয়।


আলোচনা করেন সাতক্ষীরা নাগরিক কমিটি’র সদস্য সচিব এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ, জেলা শিল্পকলা একাডেমি’র সাধারণ সম্পাদক শেখ মোসফিকুর রহিম মিল্টন, বেসরকারি সংগঠন স্বদেশ’র নির্বাহী পরিচালক মাধব দত্ত, উত্তরণের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এডভোকেট মনিরুজ্জামান, মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জোসনা
দত্ত, জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ডা: সুব্রত ঘোষ, প্রাণকেন্দ্র’র প্রধান সংগঠক সাংবাদিক আমিনা বিলকিস ময়না, নিবেদিতা বছাড়, নাট্যকর্মী শেখ আবু সালেক, সিকান্দার আবু জাফর, অনলাইন প্রেসক্লাবের আহবায়ক আলতাফ হোসেন বাবু, বারসিক’র জেলা কর্মকর্তা আসাদুল ইসলাম, আবৃত্তিকর্মী পারভেজ ইমাম, হ্যালো ডট বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট
কমের শিশু সাংবাদিক অগ্রঃ(বিসর্গ), কবি তামিম বিল্লাহ, এনসিটিএফ’র সাধারণ সম্পাদক সুজিত পাল,  শিশু শিক্ষার্থী আদৃতা বর্ষা, অভীক দাশ প্রমুখ।

অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমষ্টির জেলা প্রতিনিধি ও বিডি নিউজের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি শরীফুল্লাহ কায়সার সুমন।

সুমন সমষ্টি’র উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, কুড়িগ্রাম জেলায় পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে। ২০২০ সালের পহেলা জানুয়ারি হতে এ বছরের ২৩ জুলাই
পর্যন্ত দেশের দরিদ্রতম ও বন্যাপ্রবণ এ জেলায় অন্তত ৬৩ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। নিহতদের ৪৫ জনের বয়স নয় বছরের কম। পারিবারিক সদস্যদের অগোচরে এসব শিশুরা পানির সংস্পর্শে গিয়ে মৃত্যু বরণ করে। নিহতদের মধ্যে ২৬ জন নারী ও কন্যা শিশু এবং ৩৭ জন পুরুষ ও ছেলে শিশু। নিহতদের মধ্যে অন্তত ১৮ জন বন্যার পানিতে ডুবে মারা যায়। অন্যদিকে ৮ বিভাগের মধ্যে গত ১৯ মাসে পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে চট্টগ্রাম বিভাগে। এ সময়ে এ বিভাগের সবগুলো জেলায় অন্তত ২৭১ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক ২২৮টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ঢাকা বিভাগে। কুড়িগ্রাম ছাড়া এ সময়ে আরো ১৭টি জেলায় অন্তত ৩০ জন বা তার বেশি সংখ্যাক মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়।
এর মধ্যে নেত্রকোনায় ৫৪ জন, কিশোরগঞ্জে ৪৩ জন, চট্টগ্রামে ৪২ জন, পটুয়াখালীতে ৩৯ জন এবং দিনাজপুর ও সিরাগঞ্জে ৩৭ জন করে মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়।

অন্যদিকে শরিয়তপুর জেলায় পানিতে ডুবে সবচেয়ে কম মানুষের মৃত্যু ঘটে। গত ১৯ মাসে এ জেলায় দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। কম মৃত্যুর দিক থেকে নড়াইল, মাগুরা, বান্দরবান, রাজবাড়ী ও খুলনা জেলাও রয়েছে।

এসব জেলায় উল্লেখিত ১৯ মাসে মৃত্যু ছিল ২ থেকে ৫ জনের মধ্যে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে এরকম চিত্র দেখা গেছে। গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি
ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান সমষ্টি ২০২০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বিভিন্ন প্রবণতা বিশ্লেষণ করে আসছে।
সমষ্টি’র বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, গত ১৯ মাসে (এ বছরের ২৩ জুলাই পর্যন্ত) ৯৬৭টি ঘটনায় ১ হাজার ৫৬২ জন পানিতে ডুবে অথবা নৌযান দুর্ঘটনায় মারা যায়। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৩২ জন পানিতে ডুবে এবং ১৮০ জন নৌযান দুর্ঘটনায় ডুবে বা আহত হয়ে মারা যায়। উভয় ঘটনায় মৃতদের ১ হাজার ৫৬ জনের (৭০ শতাংশ) বয়স ১০
বছরের কম। পানিতে ডুবে মৃতদের মধ্যে নারী ও কন্যা শিশু ৫৪৯ জন (৩৬%),পুরুষ ও ছেলে শিশু ৯৫৭ জন (৬ জন)। গণমাধ্যম সংবাদ থেকে ৬ জনের লৈঙ্গিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনাগুলোর জাতীয়ভাবে কার্যকর তথ্যায়ন ব্যবস্থা না থাকায় বেশির ভাগ ঘটনাই গণমাধ্যমে উঠে আসে না। ফলে এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে জাতীয়ভাবে সর্বশেষ জরিপটি হয়েছে ২০১৬ সালে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ইউনিসেফ এর সহযোগিতায় সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ পরিচালিত ওই জরিপে তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী প্রতিবছর সব বয়সী প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি অর্থাৎ আনুমানিক ১৪ হাজার ৫০০ জনই ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। অন্যভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের শিশুরা পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা প্রতিদিন প্রায় ৩০ জন, অর্থাৎ বছরে প্রায় ১০ হাজার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর ৪৩ শতাংশের কারণ পানিতে
ডুবে মারা যাওয়া।
সমষ্টি’র গবেষণায় দেখা যায়, গত ১৯ মাসে নৌযান দুর্ঘটনা বাদে পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটনা ঘটে চট্টগ্রাম বিভাগে, ২৭১ জন (২০%)। এছাড়া ঢাকায় ২২৮ জন, রংপুরে ২০১, রাজশাহীতে ১৮৫, ময়মনসিংহে ১৪১, বরিশালে ১২৭, খুলনা বিভাগে ১০৮ জন মারা যায়। এ সময়ে সবচেয়ে কম মৃত্যু ছিল সিলেট বিভাগে, ৭১ জন (৫%)।
পানিতে ডুবে মৃতদের ৯১ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের কম। চার বছর বা কম বয়সীদের মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যু সবচয়ে বেশি, ৫৬২ জন (৪২%)। ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী ৪৬২ জন (৩৫%), ১০-১৪ বছরের ১৫২ জন এবং ১৫-১৮ বছরের ৩৮ জন। ১১৮ জনের বয়স ছিল ১৮ বছরের বেশি।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ সময়ের মধ্যে পানিতে ডোবার ৭৯ শতাংশ ঘটনা ঘটে দিনের বেলায়। দিনের বেলায় শিশুরা পানির সংস্পর্শে বেশি যায়। দিনের প্রথম ভাগে অর্থাৎ সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে ৫৩৭ জন (৪০%) এবং দুপুর থেকে
সন্ধ্যার আগে ৫১৭ (৩৯%) জন মারা যায়। তবে রাতেও পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সন্ধ্যা বা রাতে ২৬৫ (২০%) জনের মৃত্যু হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে ১২ জনের পানিতে ডোবার সময় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বর্ষাকাল ও এর আগে-পরের মাসগুলোতে (জুন-অক্টোবর) পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ২০২০ সালে সর্বোচ্চ সংখ্যক ১৩২ জন মারা যায় আগস্ট মাসে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল জুলাই মাসে ১২৪ জন। এ বছরের জুলাই মাসে (২৩ জুলাই পর্যন্ত) ১২৮ জনের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তবে মে ও জুন মাসেও শতাধিক করে মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এ দুই মাসে যথাক্রমে ১১৪ ও ১৪২ জন পানিতে ডুবে মারা যায়।

পরিবারের সদস্যদের যথাযথ নজরাদারি না থাকায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পানিতে ডোবার ঘটনা ঘটে। পানিতে
ডুবে ১ হাজার ৩৩২টি মৃত্যুর প্রায় ৯৭ শতাংশ (১,৩০৫) ঘটে পরিবারের অন্য সদস্যদের অগোচরে। অধিকাংশ শিশু বড়দের অগোচরে বাড়ি সংলগ্ন পুকুর বা অন্য জলাশয়ে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। একই পরিবারের একাধিক সদস্য পানিতে ডুবে মারা গেছে। গত ১৯ মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়Ñ ১০৯টি পরিবারের ২৪৫ জন সদস্য পানিতে ডুবে মারা যায়। যাদের মধ্যে শিশুর সঙ্গে ভাই অথবা বোনসহ ১২১ জন, বাবা-মাসহ ১৬ জন, দাদা-দাদি বা নানা-নানিসহ ৮ জন, চাচাত বা খালাতো ভাই বা বোনসহ ৮৫ জন, চাচা-খালাসহ ১৫ জন মারা যায়। উৎসব বা অন্য কোনো সময়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে একই পরিবারের বেশিরভাগ শিশু মারা যায়।

পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক দিবস
এ বছর ২৮শে এপ্রিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক প্রথমবারের মতো পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধ বিষয়ক একটি ঐতিহাসিক রেজুলেশন গৃহীত হয়েছে। এর ফলে
জাতিসংঘ ২৫শে জুলাইকে ‘বিশ^ পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। রেজুলেশনটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথম উত্থাপন করেন
জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা।
বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর বিষয়টি একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে অধিকতর গুরুত্বারোপ করেছে। সরকার ও দাতা সংস্থার যৌথ
উদ্যোগে পাইলট ভিত্তিতে কয়েকটি জেলায় কিছু কিছু কাজ হচ্ছে। শিশু সুরক্ষার জন্য দেশব্যাপী এসব কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এ বিষয়ে ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) প্রণয়ন করা হয়েছে। ডিপিপিটি একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন দৈনিক প্রত্রদূতের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক লায়লা পারভিন সেঁজুতি। সেঁজুতি বলেন, বাবা-মায়ের মধ্যে সচেতনতাবোধ তৈরী হতে হবে। শিশুদেরকে সাতার শেখার পরিবেশ করে দিতে হবে, সাতার শেখার বিকল্প কিছু নেই। অনলাইন আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন এনসিটিএফ’র জেলা সভাপতি আবৃত্তিকর্মী ফারিয়া যুথী।





০ মন্তব্য

আরও পোস্ট পড়ুন

মতামত দিন