♣♣♣
এসএম শহীদুল ইসলাম:
জেলা ও দায়রা জজ সাদিকুল ইসলাম তালুকদার বলেছেন, রাজনীতিক ও সাংবাদিকরা আইন জানলে দেশের কল্যাণ হয়। আইন দুইভাবে হয়। একটি পার্লামেন্টে আরেকটি সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে। দেশে আইন জানা লোকের সংখ্যা খুবই কম। আইন জানা থাকলে অনেক কিছুই লেখা যায়। অজ্ঞতার কারণে অনেক সময় ভুল তথ্য ও ভুল বানান লেখা হয়। বাংলা ভাষায় ভুল লিখলে আমার খুব খারাপ লাগে। অজ্ঞতার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক সময় অনাস্থা-অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। আদালতে আইনের বিচার হয়। বিচারালয়ে আবেগের কোনো মূল্য নেই। আইন বলে ‘সাক্ষী লাগবে’। সন্দেহ কোনো দ-ের ভিত্তি হতে পারেনা।
তিনি বুধবার সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের শহীদ স.ম আলাউদ্দীন মিলনায়তনে আইন সহায়তা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ও গ্রাম আদালত বিষয়ক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, একই ঘরে অবস্থানরত দুজন ব্যক্তির একজন খুন হলে ওই ঘরে অবস্থানরত অপর ব্যক্তিকেই প্রমান করতে হবে সে খুনের সাথে জড়িত নয়। তাকেই বলতে হবে এবং আদালতকে বিশ্বাস করাতে হবে যে কীভাবে খুন হয়েছে। অন্যথায় খুনের দায় তাকেই নিতে হবে। অনুরূপভাবে মাদকের ক্ষেত্রেও একই বিধান। কারো বাড়ি থেকে মাদক উদ্ধার হলে বাড়িওয়ালাকেই প্রমান করতে হবে তিনি মাদকের সাথে জড়িত নন। অন্যথায় ধরে নেওয়া হবে তিনি মাদকের সাথে জড়িত। তিনি আরো বলেন, ধর্ষণের ক্ষেত্রে অনেক সময় আলামত নষ্ট হয়ে যায়। ধর্ষণের পর কোনো নারী বা শিশু সাধারণত বিষয়টি দেরিতে প্রকাশ করে। এক্ষেত্রে ২৪ ঘন্টা থেকে ৭২ ঘন্টার মধ্যে মেডিকেল রিপোর্ট করাতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণ ঘটনার পর পরিবারের লোকজন সেই নারীকে দ্রুত গোসল করায়। এ ক্ষেত্রে মেডিকেল সার্টিফিকেটের সাথে দরকার ধর্ষিতার কাপড়চোপড়ের কেমিক্যাল রিপোর্ট। অনেক সময় পুলিশ (আইও) তদন্ত রিপোর্টে তা উল্লেখ করেন না। আবার বাদীপক্ষের কাছে আলামত হিসেবে কাপড়চোপড় চান না। আবার বাদীপক্ষ কাপড়চোপড় ধুয়ে ফেলার কারণে আলামত নষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ডাক্তারী রিপোর্ট ও কেমিক্যাল রিপোর্টে পার্থক্য দেখা দিতে পারে। এতে আসামী খালাস পেয়ে যেতে পারে।
আবার দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তা হলে ছয় মাস পর্যন্ত কাপড় চোপড়ে আলামত মিলানো যায় বলে প্রমান করে থাকেন। এমনটি হলে ভিকটিম ন্যায় বিচার লাভ করতে পারেন। কাপড় চোপড়ের কেমিক্যাল রিপোর্ট তৈরি না করায় অনেক গণধর্ষণের ক্ষেত্রেও আসামীদের সাজা হয়না। ‘নো সাইন অব রেপ স্পন্ট’ হওয়ায় বিচারপ্রার্থী যেমন বঞ্চিত হন তেমনি এর দোষ চাপে বিচারকের ওপর।
জেলা ও দায়রা জজ বলেন, আমাদের দেশে ব্রিটিশরা যখন আইন প্রনয়ন করেছিলো তখন আইন বাদীর পক্ষে ছিলো। ব্রিটিশদের আইন অবশ্য আসামীর পক্ষে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, দেশের ৯৮ শতাংশ আইন আসামীর পক্ষে উল্লেখ করে তিনি বলেন মাদক, হত্যা, ধর্ষণ যে অপরাধের কথাই বলা হোক সেখানে যথেষ্ট প্রমান লাগবে। মাত্র দুই শতাংশ আইন প্রসিকিউশনের পক্ষে। বর্তমানে ক্রিমিন্যাল মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এসব কারণে অনেক মামলায় আসামীরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে।
প্রেসক্লাব সভাপতি অধ্যক্ষ আবু আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সাতক্ষীরা ল কলেজের অধ্যক্ষ এসএম হায়দার।
শ্রাবণ সন্ধ্যায় নান্দনিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত এ মতবিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি সাদিকুল ইসলাম তালুকদার সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
তিনি বলেন, এভিডেন্স আইনের ক্ষেত্রে অনেক বড় অনুসঙ্গ। এর তিনটি ভাগ রয়েছে। সেগুলো হলো, প্রত্যক্ষ, দালিলিক ও অবস্থাগত। কানে শোনা এভিডেন্স কোনো এভিডেন্স নয়। এ ধরনের এভিডেন্স হাজির করলে তৃতীয় পক্ষ সুবিধা পায়। সংবাদ কর্মীদের সঠিক রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট ডাক্তার ও ম্যাজিস্ট্রেটকে সতর্ক করতে পারে। একটি অপরাধের সাথে জড়িত দুই জনের একজন অপরাধ স্বীকার করলে এবং অপরজন স্বীকার না করলে দন্ডে তারতম্য হতে পারে। বর্তমানে বিস্ফোরক মামলা বেশি হচ্ছে উল্লেখ করে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ বলেন, এক্ষেত্রে কেমিক্যাল পরীক্ষা খুবই জরুরী। কেমিক্যাল পরীক্ষা ছাড়া চার্জশীট দিলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। প্রতি একশত মামলার ৯৯টিতে রাসায়নিক পরীক্ষার রিপোর্ট থাকে না।
জেলা ও দায়রা জজ আরো বলেন, আসামি পক্ষের আইনজীবীরা বেশি পড়াশুনা করে থাকেন। প্রসিকিউশন এমনকি জিপিরাও পড়াশুনা বেশি করেন না বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনজীবীদের দক্ষতার মাপকাঠির ওপর বিচার নির্ভর করে।
ভ্রাম্যমাণ আদালত সম্পর্কে তিনি বলেন, সচরাচর পুলিশ আসামিকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করে তার অপরাধের কথা বলায়। তিনি বলেন, আইন হলো: ঘটনাস্থলে ম্যাজিস্ট্রেটকে উপস্থিত থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের ঘুম ভাঙিয়ে তার স্বাক্ষর নেয় পুলিশ। আইনে এটা গ্রহণযোগ্য নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, অপরাধী অপরাধ সংঘটনের সময় কোনো না কোনো চিহ্ন রেখে যাবেই। এ প্রসঙ্গে তিনি ব্রিটেনে একজন নারী ধর্ষণের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কেউ মিথ্যা মামলা করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। জেলা ও দায়রা জজ বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য শেষ হলেই কেবল আসামী তার বক্তব্য দিতে পারেন। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের সময় তিনি দোষী না নির্দোষ তা বলতে পারেন। তিনি সরকারের দেওয়া আইন সহায়তা গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করে আরো বলেন, একই সাথে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ওপর সমান গুরুত্বারোপ করে বলেন, গ্রাম আদালত একটি চমৎকার বিচার ব্যবস্থা। এটি বেগবান করা গেলে দেশের বিচার ব্যবস্থার উপর চাপ কমবে। তাছাড়া মানুষও স্বল্প খরচে কম সময়ে ন্যায় বিচার পাবে। বিভাগীয় পর্যায়ে সাইবার কোর্ট স্থাপনে সরকারের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, হত্যা মামলা ও ধর্ষণ ঘটনায় সাক্ষীর খুবই দরকার। তিনি সকলকে আইন সম্পর্কে সচেতন হবার আহবান জানিয়ে আরও বলেন, আইন মানুষের চোখ খুলে দেয়। এতে ন্যায় বিচার পাওয়া সহজ হয়।
সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল বারীর পরিচালনায় মতবিনিময় সভায় বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রশ্ন রাখেন, প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সুভাষ চৌধুরী, সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ আনিসুর রহিম, প্রথম আলোর স্টাফ রিপোর্টার কল্যাণ ব্যানার্জী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম কামরুজ্জামান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মমতাজ আহমেদ বাপী, ভোরের কাগজের এড. দিলীপ কুমার দেব, প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম সরোয়ার, আরটিভির রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী, একাত্তর টেলিভিশনের বরুন ব্যানার্জী প্রমুখ। প্রধান অতিথি জেলা ও দায়রা জজ সাদিকুল ইসলাম তালুকদার সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এসময় প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়ার সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
সূত্রঃপত্রদূত নেট।