দেশজুড়েই ভয়াবহ আকার নিয়েছে ‘কিশোর গ্যাং’ সংস্কৃতি। বড়দের ছত্রছায়ায় অপরাধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে টিনেজারদের। আধিপত্য বিস্তার থেকে শুরু করে, চাঁদাবাজি, মাদক, খুনাখুনিসহ হরেক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অকালেই ঝরে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় অনেক প্রাণ।

ভিনদেশী এই সংস্কৃতির রাশ টেনে ধরতে শুন্য সহিষ্ণুতার নীতি নিয়েই দীর্ঘদিন যাবত আভিযানিক কর্মকান্ড পরিচালনা করছে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। ২০১৭ সাল থেকে এখন অবধি ৩৭৩ জন কিশোর অপরাধীদের নিয়ে এসেছে আইনের আওতায়। কিন্তু ভয়াবহ এই সমস্যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে এককভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব নয় মোটেও।

জনসম্পৃক্ততা ও সচেতনতার মাধ্যমেই সম্মিলিতভাবেই কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের মাধ্যমেই হালের বিষফোঁড়া এই গ্যাং কালচারকে সমূলে মূলোৎপাটন করার বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে র‌্যাব। জনসচেতনতামূলক প্রচারণার বার্তা দিতেই তৈরি করেছে মর্মস্পর্শী এক টিভিসি। নিজেদের সুদৃঢ় অঙ্গীকার ফুটে উঠেছে ‘সবার হোক একটাই পণ, কিশোর অপরাধ করবো দমন’ শীর্ষক স্লোগানেও।

বৃহস্পতিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মধুবাগে অবস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান কমপ্লেক্সে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এই টিভিসি উদ্বোধন করেন।

এই অনুষ্ঠানেই কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে বয়সসীমা নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ এক বার্তা উচ্চারিত হয়েছে। পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.বেনজীর আহমেদ, বিপিএম (বার) অকাট্য যুক্তি আর বস্তুনিষ্ঠতার আলোকচ্ছটায় দ্যুতিময় উপস্থাপন করেছেন প্রসঙ্গটির। বিষয়টি নিয়ে মোটা দাগে ভাবনা-চিন্তার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও।

কন্ঠ মিলিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম, জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন ও র‌্যাব ডিজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন থেকে শুরু করে সবাই। একই সঙ্গে প্রত্যেক অভিভাবককেও নিজ নিজ সন্তানের প্রতি যত্নবান হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। সচেতনতার পরেও সুপথে না এলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থার হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন র‌্যাব ডিজি।

১৮ বছরের নিচে সবাইকে শিশু হিসেবে আখ্যায়িত করার বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে চিন্তা-ভাবনার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি যখন এসএসসি পাস করেছি তখন বয়স ছিল ১৫ বছর। বর্তমানে যারা নিয়মিত পড়াশোনা করে ১৮ বছর বয়সে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। আমাদের মনে হয় ১৮ বছরের এই সময়সীমা চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসেছে। আন্তর্জাতিক একটি আইনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় সমন্বয় করে এটি করা হয়েছে। কিন্তু এর ফলে কিশোর অপরাধ দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বেগ পেতে হচ্ছে, তাই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবনার কথা বলেন মন্ত্রী।

‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে, এটি ধরে রাখার প্রথম শর্ত হচ্ছে নিরাপত্তা’
উল্লেখ করে আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘আমাদের কিশোররা নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের শঙ্কার বিষয় ছিল কোভিডকালীন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকবে, সবাই বসে থাকবে। তবে এ সময়ে কিশোরদের নিয়ে যে শঙ্কাটা ছিল ততখানি হয়নি। আমাদের দেশ অনেক দেশের তুলনায় ভালো আছে।’

তিনি বলেন, ‘পুলিশ-র‌্যাব, শিক্ষক ও সমাজ তার কার্যক্রম চালাচ্ছে। তারপরেও অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি কেন? তাই বিষয়টি নিয়ে খেয়াল না করলে আমাদের সন্তানকে হারিয়ে ফেলবো। দেশ-জাতির সবাই নিগৃহিত হবে। সমাজের শাসন যদি সুপ্রতিষ্ঠিত করতে না পারি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যতই কড়াকড়ি হোক আমরা হারিয়ে যাব।

তাই সময় থাকতে সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষা দিন, তাদের সঙ্গে কথা বলুন। সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কি করছে খেয়াল করুন। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। তবে আপনার সন্তানদের প্রতি যদি খেয়াল না রাখেন এটি আমরা কখনোই পারবো না।’

কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে অভিভাবকদের সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছেন মন্ত্রী বলেন, ‘জঙ্গিবাদের মতো কিশোর গ্যাংও এই দেশ থেকে নির্মূল করা হবে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি অভিভাবকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।’

মন্ত্রী বলেন, ‘মা-বাবা যদি সন্তানের প্রতি খেয়াল না করে শুধু মাদক ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে অভিযানে কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দেবে যেই তরুণ প্রজন্ম, তারা যেন পথ না হারায়, এজন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।’

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, ‘বাবা-মায়ের অতি আদর কিংবা সময় না দেওয়া বাচ্চাদের মনে প্রভাব ফেলে। শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকদের শারীরিক নির্যাতন করা বৈধ নয়, কাউন্সিলিংয়ে জোর দিতে হবে। শিশু-কিশোরদের মনোজগতে প্রবেশ করতে হবে।

আমরা কিন্তু বাবা-মারা সন্তানের বন্ধু হতে পারিনা। বন্ধু হতে পারলে তাদের যে সমস্যাটা সেটা যেন আমাদের কাছে শেয়ার করতে পারে সেরকম একটা সুযোগ তৈরি হলে কিন্তু এতো অঘটন ঘটবে না।

উদাহরণ টেনে বলেন, ‘আমরা যদি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব দেখি। তার শৈশব কিন্তু মানবিকতাপূর্ণ একটি জীবন ছিল। তিনি শৈশব থেকেই মানবাধিকারের চর্চা করেছেন। সারা জীবন মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেছেন।

আমাদের ভেতরে কেন মূল্যবোধ জাগ্রত হবেনা। কেন পরিবার থেকে ছেলে, বাচ্চাকে শিক্ষা দেওয়া হবে না সৎ পথে চলতে। মিথ্যা কথা না বলতে। আমাদের প্রত্যাশা আগামী প্রজন্ম মানবিক চেতনায় বড় হয়ে উঠবে। আমরা যে বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চাই, সেই ডিজিটাল বাংলাদেশকে তারা যেন বিশ্বের বুকে একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করে তুলতে পারে।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ দেশের আভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এছাড়াও দেশের সীমান্ত সুরক্ষা, আমাদের উপকূলীয় সুরক্ষা এবং আভ্যন্তরীণ যেকোন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা ও মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সুদক্ষ নেতৃত্বে আমাদের মন্ত্রণালয় অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, একটা রাষ্ট্রের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা। সেই লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট হিসেবে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) দক্ষতার সাথে তাদের কর্মকান্ড পরিচালিত করছে।

কিশোরের সজ্ঞা একেক জায়গায় একেক ধরনের, প্যানাল কোডে এক ধরনের। এক সময় ৯ বছর ছিল, এখন ১৪ বছর, শিশু আইনে আছে এক ধরনের ১৬ বছর পর্যন্ত; শ্রম আইনে আছে এক ধরনের ১৮ পর্যন্ত। এটাকে একটি সমন্বয়ের মধ্যে নিয়ে আসা দরকার। তথাপি বিভিন্ন আইনে ব্যঞ্জনা একেক রকম। আমাদের দেখতে হবে অপরাধটা কোন আইনে করেছে। প্যানেল কোড মতে যদি এখন ১৪ বছর হয় সেটা অনেক ভালো। কারণ এই বয়সে এখন সবাই বুঝে। আধুনিক যুগে টিভি, ফেসবুক, ইউটিউব দেখে এই বয়সে ম্যাচিউড হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আমার মনে হয় প্রত্যেকটা আইনের মধ্যে একটি সমন্বয় আনা দরকার।’

কিশোররা কেন অপরাধ করে তার উৎস খুঁজে বের করতে হবে উল্লেখ করে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এই জ্যেষ্ঠ সচিব বলেন, ‘অপরাধ শুধু নিয়ন্ত্রণ করলে হবেনা; তাদের কারা অপরাধী বানাচ্ছে, কারা তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে, কারা তাদের দিয়ে মাদক বিক্রি করাচ্ছে সেসব লোকদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের সমাজ বিজ্ঞানী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের এগিয়ে আসতে হবে।

যুগের সাথে তাল মিলিয়ের কিশোর অপরাধ দমন করতে হবে জানিয়ে মোস্তফা কামাল উদ্দীন বলেন, আমাদের সকলকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে অপরাধ দমন করা সম্ভব না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো, তবে সমূলে উৎপাটন করা যাবে না।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম-বার বলেন, ‘কিশোর গ্যাং’ গত তিন চার বছর ধরে আমাদের আইনশৃঙ্খলার প্রেক্ষাপটে একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা দেশ উপযোগী, সময় উপযোগী আইন প্রণয়ন করছেন। আমাদের বিচার বিভাগ স্বাধীন।

উচ্চ আদালত, হাইকোর্ট আপিল বিভাগ বিভিন্ন সময়ে গণতান্ত্রিক দেশের উপযোগী অনেক বিধান এবং নির্দেশনা দিচ্ছেন। ফলে সভ্য দেশের সমস্ত লক্ষণ ফুটে ওঠার বিষয় অনেক স্পষ্ট। সেভাবেই আমাদের কিশোর আইন হালনাগাদ করা হয়েছে। কিশোর আইন হালনাগাদ করার ফলে যেটা হয়েছে যে এখন ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সের যে কেউ হচ্ছে শিশু।

যেটি ব্রিটিশ আমলের আইন এভাবে ট্রিট করে না। ব্রিটিশ আমলের আইন ছিল এরকম যে, শিশু আইন ছিল ৮ বছর মাত্র। তারপরেও যদি কোন অপরাধ করার ক্ষেত্রে ৮ বছরের শিশু এমন কোন আচরণ করতো যে সে বুঝে অপরাধটা করছে তাহলে তাকেও বয়স্ক অপরাধের সমান বিবেচনায় নিয়ে তার বিচার করা হতো। কিন্তু বর্তমান দেশে আইন পরিবর্তন করার ফলে যেটা হয়েছে ১৮ বছরের মত পূর্ণ যুবকের পর্যায়ে পৌঁছে যায় তাকেও কিন্তু এখন শিশু হিসেবে বিচার করা হয়। এই কারণে কিশোর গ্যাংদের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি এখন সেভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি বলেন, ‘এখন বর্তমানে আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়স পর্যন্ত বিচার পদ্ধতি, গ্রেফতার পদ্ধতি সব কিছু আলাদা। গ্রেফতার করার সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে প্রবেশন অফিসারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আবার মুশকিল হচ্ছে যে, বাংলাদেশে কোথায় কোন প্রবেশন অফিসার আছে আমরা জানি না। এই আইন বলবৎ করতে কত সংখ্যক অফিসার থাকতে হবে, বিস্তারিত বলা নেই।

এসব প্রবেশন অফিসাররা কাজ করে আবার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আমরা কাজ করি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। দু’টি ভিন্ন মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে সমন্বয়ের দরকার, আমরা সমন্বয়ের চেষ্টা করছি।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে আইজিপি বলেন, যদি যথেষ্ট সংখ্যক প্রবেশন অফিসার না থাকে তাহলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সেই পরিমাণ প্রবেশন অফিসার নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। আবার বললেই কিন্তু নিয়োগ হয় না। এটা প্রাইভেট সেক্টর না। বর্তমানে সরকারিভাবে একজন পিয়ন নিয়োগ করতে হলেও ১৩ টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। আর একধাপ যদি একমাস লাগে তাহলে ১৩ মাস। প্রচলিত পদ্ধিততে পিয়ন নিয়োগেও কোনোক্রমে দুই বছরের আগে আমাদের ক্ষমতা নেই। চাইলেও প্রবেশন অফিসার নিয়োগ হয়ে যাবে না।

বর্তমানে এসব চ্যালেঞ্জ আমাদের রয়েছে। বর্তমানে আইন অনুযায়ী একজন কিশোর অপরাধীকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো যাবে না। পাঠাতে হবে কিশোর সংশোধানাগারে। আর সেগুলোর সংখ্যাও যথেষ্ট নয়। এখন বাংলাদেশে কত কিশোর অপরাধ বা অপরাধী আছে তাদের সংখ্য কত, কারেকশন সেন্টারের সংখ্যা কত, কার ক্যাপাসিটি কত এগুলো নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।

নিজের সন্তানদের প্রতি যত্নবান হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ড.বেনজীর আহমেদ বলেন, কিশোর ছেলে-মেয়েরা কী করছে, কোথায় যাচ্ছে এখানে প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের বিষয়টাও রয়েছে। প্রতিটা পরিবারকে খেয়াল রাখতে হবে বাচ্চারা কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে এবং কী করছে। দেশ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০৪১ সালের উন্নত ও ধনী বাংলাদেশের উপযোগী একটি জেনারেশন আমাদেরই তৈরি করতে হবে।

র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে ছোটদের সঙ্গে বড়রাও থাকে। ছোট-বড় মিলে বিরোধ হয়, পরে আলাদা গ্রুপ সৃষ্টি হয়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মারামারি বা সংঘর্ষের মতো ঘটনা ঘটে।

তিনি বলেন, সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন আমাদের জন্য একটি অ্যাসেট। এই অ্যাসেট ধরে রাখতে পারলে সন্তানদের বিচ্যুতি থেকে ঠেকানো সম্ভব। কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ার দায় সবার রয়েছে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক পথে ধাবিত করতে সচেতনতা সৃষ্টিতেও তিনি আহ্বান জানান।

ডিজি বলেন, যেহেতু আমাদের সকলের দায় তাই আমরা চাই সকলে মিলে এই দায়বদ্ধতা থেকে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যেন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিকপথে পরিচালনা করতে পারি। আমরা যেন গর্ববোধ করতে পারি আমাদের সন্তানের জন্য সেইভাবেই তাকে গড়ে তুলতে হবে। উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের সন্তানরা ভূমিকা রাখতে পারে এরকম দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে তাদেরকে গড়ে তুলতে হবে।

তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এই করোনা দুর্যোগেও জীবন এবং জীবিকার একটি সুষ্ঠু সমীকরণ রচনা করে আমরা উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রেখেছি। যে উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখা হয়েছে সেই উন্নয়নের চাকাকে যেন কোন ক্রমেই কেউ যেন পিছনের দিকে ঠেলে দিতে না পারে সেদিকে সবার সতর্ক থাকার দরকার আছে।

যুব সমাজকে যদি ধ্বংস করা দেওয়া যায়, আমাদের এই শিশুদের যদি ধ্বংস করে দেওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দেওয়া যাবে। যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি আমরা ২০৩০ সালে, ২০৪১ সালে। সে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। যদি আজকে আমাদের শিশুদেরকে সুপথে -সঠিকপথে পরিচালিত করতে আমরা ব্যর্থ হই, যোগ করেন র‌্যাব মহাপরিচালক।

চৌধুরী মামুন বলেন, ‘কিশোর অপরাধীদের গ্রেফতার করলে প্রবেশন অফিসারের কাছে দিতে হয় উল্লেখ করে র‌্যাব ডিজি বলেন, ‘বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ে গ্রেফতারের পর প্রবেশন অফিসার পাওয়া অনেক কঠিন ও জটিল।’

কিশোর অপরাধ দমনে সচেতনতা কার্যক্রম শুরু হয়েছে মানে এই নয়, আভিযানিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। যদি কেউ সচেতনতার মাধ্যমে সুপথে না আসে, তার বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা চলমান থাকবে, হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন তিনি।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) কর্নেল কে এম আজাদ বলেন, ‘সবার হোক একটাই পণ, কিশোর অপরাধ করবো দমন’ শীর্ষক টিভিসির মাধ্যমে শুরু হলো র‌্যাবের ‘কিশোর গ্যাং’ বিরোধী আনুষ্ঠানিক ক্যাম্পেইন।

‘বাংলাদেশ আমার অহংকার’ এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে, বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের আকুন্ঠ সমর্থন, প্রেরণা ও ভালোবাসা নিয়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার বজ্র কঠিন শপথ নিয়ে এগিয়ে চলছে র‌্যাব ফোর্সেস।’

তিনি বলেন, ‘আজকের অনুষ্ঠানের মূল ফোকাস হচ্ছে কিশোর। এই কিশোর শব্দটা শোনার সাথে সাথেই আমাদের সবার মনে একটি প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। একদল তরুণ-তরুণী যারা হাস্যেজ্জ্বল, দুরন্ত, যারা জয় করতে পারে যেকোন বাঁধা, তাঁরা অজেয়।

আজকে আমরা ‘কিশোর গ্যাং’ কালচারের কথা বলছি। এটি মূলত আমাদের সংস্কৃতি নয়। আমাদের কিশোররা বিদেশী কিছু অপসংস্কৃতি কিছুটা অনুসরণ করছে মাত্র। যা আমাদের পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু দুর্বলতার জন্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২০১৭ সালে উত্তরায় আদনান নামে একজন ছাত্রকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে মূলত কিশোর গ্যাং আলোচনায় আসে। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের মূলহোতাসহ এতে জড়িত অনেককেই আইনের আওতায় এনেছে র‌্যাব। কিশোর গ্যাং নামের এই অপসংস্কৃতি রোধকল্পে, এই সকল গ্যাং কালচারে জড়িত অনেক আসামিকে র‌্যাব ফোর্সের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের সদস্যরা গ্রেফতার করেছে। ফলে অনেকাংশেই বর্তমানে এই গ্যাং’কে অনুসরণ করা কিশোররা নিষ্ক্রিয় আছে।

তবে এটাকে এই মুহুর্তে একেবারেই শেষ বলা যাবে না। তাই র‌্যাব কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে বস্তুনিষ্ঠ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে আজকের এই অবতারণা। আমরা চাচ্ছি আমাদের আভিযানিক বিভিন্ন কর্মকান্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন জনসচেতনতা ও বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণাতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে চাচ্ছি।’

‘স্বাধীন বাংলাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের কোন অস্তিত্ব থাকবে না’ দৃঢ়কন্ঠে এমন উচ্চারণ করে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) কর্নেল কে এম আজাদ আরও বলেন, ‘গত মার্চ থেকে র‌্যাব ফোর্সেসের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন সারাদেশে অনেক অভিযান পরিচালনা করেছে এবং বর্তমানেও অব্যাহত আছে। মার্চ থেকে এই পর্যন্ত ২৩৪ জনকে র‌্যাব বিভিন্নভাবে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে।

আমরা মনে করি শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানই এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ নয়। আমরা তাদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে পরিবর্তন ঘটতে চাই। আমরা তাদের মধ্যে প্রবেশ করে কুলষিত যা আছে তা বের করে দিতে চাই। এজন্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি জনসমাজে যারা বসবাস করছি বয়োজ্যেষ্ঠ, শিক্ষক এবং আমাদের সমাজের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তাদের বুঝাতে হবে এই পথ ভুল পথ। তাদের আশ্বাস দিতে হবে আমরা আছি তোমাদের পাশে।’





০ মন্তব্য

আরও পোস্ট পড়ুন

মতামত দিন