।। যশোরবাসী গর্বিত।।
চোখের সামনে প্রতিদিন ঘটছে কত ঘটনা। কারো বিপদে পাশে দাড়ানোর বদলে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাওয়াটাই যেন জীবনের অংশ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে নিম্ন পদস্থ একজন কর্মচারীর জীবন রক্ষায় যশোর জেলা প্রশাসকের একটি মানবিক উদ্যোগ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে অনাদিকাল। সেই মহতী উদ্যোগে যেমন বেঁচে থাকার স্বপ্ন জিইয়ে রইলো একজন জীবনামৃত কর্মীর তেমনি মাত্র পনের দিন আগে ভূমিষ্ঠ এক কন্যা বড় হয়ে জানবে তার বাবার জীবন রক্ষায় একজন বড় মানুষের বড় হৃদয়ের উপাখ্যান। যা হার মানাতে পারে রুপালী পর্দার কোন গল্পকেও। গত বুধবার সন্ধ্যায় শার্শা উপজেলা ভূমি অফিসের এমএলএসএস আব্দুল হালিম সড়ক দূর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন। জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সেনাবাহিনীর সহায়তায় বিমান বাহিনীর বিশেষায়িত হেলিকপ্টারে করে ঢাকা সিএমএইচে পাঠিয়েছেন যশোর জেলা প্রশাসক। নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন তার অধনস্থ একজন স্বল্প বেতনের কর্মচারীর যাবতীয় চিকিৎসা ব্যয়। সে কথা বলতে আবেগে অশ্রুসজল হয়েছেন যশোর কালেক্টরেটের অনেক কর্মচারী।

যশোর সদর উপজেলার পাঁচবাড়ীয়া গ্রামের কৃষক হাশেম আলীর দুই মেয়ে তিন ছেলের মধ্যে চতুর্থ ও তিন ছেলের মধ্যে মেঝ আব্দুল হালিম। দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করায় লেখাপড়া বেশী দূর এগোয়নি। বছর তিনেক ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় এমএলএসএস পদে চাকুরি জুটেছিল যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। নিয়োগের পর কর্মস্থল ছিলো শার্শা উপজেলা ভূমি অফিস। সেই থেকে তিনি সেখানে কর্মরত ছিলেন। চাকুরী পাবার পর খুলনা ছোট বয়রার মেয়ে লোপা খাতুনের সাথে শুরু করে ছিলেন সংসার জীবন। দিন পনের আগে যশোর পপুলার ক্লিনিকে তাদের সংসার আলো করে এসেছে সিজারিয়ান সন্তান। সব পিতার কাছেই তার মেয়ে রাজকন্যা। তাই আদর করে নাম আব্দুল হালিম আর লোপা রাজকন্যার নাম রেখেছিলেন নাহিদা। ক্লিনিক থেকে রিলিজ দিলেও জন্মের পর থেকেই অসুস্থ থাকায় বাড়িতে না এসে স্ত্রী কন্যাদের পাঠিয়ে দেন খুলনায় শশুরালয়ে। নিজে থাকতেন শার্শা সরকারি কোয়াটারে।

প্রতিদিনের মতোই বুধবার সন্ধ্যায় অফিসের কাজ শেষ করে শার্শা বাজারের দিকে আসছিলেন। কিন্তু কালকের সন্ধ্যা যে তার জীবনে কালসন্ধ্যা হয়ে আসবে তা কে জানতো। রাস্তা পার হবার সময় বেনাপোলের দিক থেকে বেপরোয়া গতিতে আসা মোটর সাইকেল আরোহী তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। পিছন থেকে আকস্মিক সজোরে আঘাতে রাস্তার রাস্তায় পড়ে যান তিনি। মাথার পিছনের দিকে মারাত্মক আঘাতে রক্ত ক্ষরণ শুরু হয়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটলে শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পুলক কুমার মন্ডল তাকে সাথে নিয়ে রাত সাড়ে আটটার দিকে যশোর ২শ’৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করেন। এসময় তিনি বিষয়টি যশোর জেলা প্রশাসনকে অবহিত করেন। যশোর জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুল আওয়াল ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( সার্বিক) মোঃ হুসাইন শওকত তখন ঢাকায় নির্বাচনী জরুরী মিটিং শেষ করে যশোরে ফিরছিলেন। মধুখালীর কাছাকাছি অবস্থানে থাকতে দূর্ঘটনার খবর পান। তাৎক্ষণিক ভাবে দ্রুত চিকিৎসার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে যোগাযোগ করেন। যশোরে পৌঁছেই তিনি হাসপাতালে গিয়ে আব্দুল হালিমের খোঁজ নেন। আইসিইউতে নিবিড় পরিচর্যার সুবিধা না থাকায় আহত আব্দুল হালিমকে রাত সাড়ে দশটার দিকে যশোর সি এইম এইচে ভর্তি করা হয়। নিউরোসার্জন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মোতাবেক উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে বিপত্তি বাধে যাতায়াতের। লাইফ সাপোর্ট সুবিধা সম্বলিত এ্যাম্বুলেন্সে সুবিধা না থাকায় একমাত্র বাহন হয়ে উঠে সেনাবাহিনীর জন্য ব্যবহৃত বিশেষায়িত হেলিকপ্টার। একটি উপজেলা পর্যায়ের অফিসের পিয়ন কাম নাইট গার্ডের পরিবারের সামর্থ্য নেই হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করানো। তাই সে ভাবনা পরিবারের কাছে ছিলো স্বপ্নের মতো। কিন্তু দুঃসময়ে অস্বচ্ছল পরিবারটির পাশে পরম মমতায় স্বজন হয়ে উঠেন যশোর জেলা প্রশাসক। তিনি নিজ দায়িত্বে আব্দুল হালিমের উন্নত চিকিৎসার ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও নার্স সহ বিশেষায়িত হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করে দেন। গতকাল দুপুর দুটোয় যশোর বিমান বন্দর থেকে ঢাকায় নেওয়ার সময় তিনি নিজে বিমান বন্দরে উপস্থিত থেকে অসুস্থ হালিমের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। আব্দুল হালিম বর্তমানে ঢাকা সি এম এইচে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসাধীন আছেন।
যশোর কালেক্টরেটের নেজারত শাখার নাজির হাবিবুর রহমান হাবীব এ বিষয়ে বলতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন যশোর কালেক্টরেটের দুই’শ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা পূর্বে ঘটেছে বলে শুনিনি। নিম্ন পদস্থ একজন সহকর্মীর প্রতি জেলা প্রশাসক মহোদয় যে মহানুভবতার পরিচয় দিলেন তাতে শুধু তিনি নন গোটা প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারিরা অভিভূত। এমন দায়িত্বশীল অভিভাবকের তত্ত্বাবধায়নে কাজ করতে পারাটাও সৌভাগ্য । এই কথাটাই এখন প্রতিধ্বণিত হচ্ছে যশোর কালেক্টরেটের সকল কর্মচারির মুখে মুখে।

গুরুতর অসুস্থ আব্দুল হালিমের বিষয়ে জানতে চাইলে যশোর জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুল আওয়াল বলেন, পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে যেমন কষ্ট হয় ঠিক তেমনিই অনুভূতি হয়েছিলো দূর্ঘটনার খবর শোনার পর। কে কোন পদে আছে সেটা বিবেচ্য নয়, সবার আগে মানুষের জীবন। তিনি শুধু তার জায়গা থেকে শুধু অভিভাবকের দায়িত্বটা পালন করেছেন মাত্র। এ সময় তিনি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপণ করেন যশোর সেনানিবাসের জিওসি, বিমান বাহিনী এবং সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল কর্তপক্ষের প্রতি। তিনি বলেন,যদি তারা দ্রুত রেসপন্স না করতেন তাহলে এত দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া যেত না। তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে আব্দুল হালিমের দ্রুত সুস্থ্যতা কামনা করেন।

‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ মানবিক এই কথাটি যেন আবারো অনূদিত হলো যশোর জেলা প্রশাসকের এই নন্দিত উদ্যোগে।





০ মন্তব্য

আরও পোস্ট পড়ুন

মতামত দিন