আমি বলি, দেশটি আমার। আমরা বলি দেশটি আমাদের।
এই মাটি, এই সবুজমাখা বৃক্ষ আমার। বয়ে যাওয়া জালের মতো নদী, পলিমাটির ধূলিকণা আমার। এই আমার, এই যে আমি, আমি যে বলি, আমার, দেশটি আমার। এই আমার কীভাবে হলো?
উত্তরে কেউ বলবে, এটা তো ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে বিপ্লব করতে করতে শুরু হয়েছিল। কেউ বলবে, তাহলে ক্ষুদিরাম বসু! ১৯১৮ সালে জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে। তাহলে এই আমিত্বের বীজ বপন অনেক আগেই হয়েছিল। কিন্তু একটি পরিপূর্ণ গাছে পরিণত হতে পারিনি। যুগে যুগে শত সহস্র বাধা পেরিয়ে এলেন একজন মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বীজ থেকে ফলে পরিণতি করলেন এই মাটিকে।
আমরা পেলাম আমাকে, একটি স্বাধীন ভূখণ্ড।
শেষ হলো দুইশ বছরের গোলামির ইতিহাস। বলতে থাকলাম, আমার দেশ। দেশটি এখন আমার। আমাদের। এই স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে সর্বপ্রথম অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স-এ পুলিশের বীর সদস্যরা। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে অকুতোভয় এই যোদ্ধারা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে।
বীর পুলিশ সদস্যরা সেই রাতে আকস্মিক আক্রমণে মাথা নত না করে বুক ফুলিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নেন। থ্রি নট থ্রি রাইফেলের ট্রিগার চেপে বসেন। শুধু তা নয়, আক্রমণের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের বেতারের মাধ্যমে সারাদেশে জানিয়ে দেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সসহ সারাদেশের পুলিশ লাইন্সগুলোতেও শুরু হয় প্রতিরোধ যু্দ্ধ। এর ফলে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে পারে পুলিশ ও আপামর সাধারণ মানুষ।
তখন নিজ চোখে দেখা রাজারবাগের স্মৃতি বহন করে চলেছেন অনেকে। তাদের কথা ওঠে এসেছে বাস্তবতার ছাপচিত্র হয়ে। যেমন, একাত্তরের স্মৃতিকথা নামে লেখাটিতে মতিয়া চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, … রাত যত গভীর হতে থাকে উৎকন্ঠা তত বাড়তে থাকে। এত উৎকন্ঠার মধ্যেও কান সরাইনি আমরা। তারপর একসময় শুনতে পাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা। উৎকন্ঠা আর উত্তেজনায় সেই এক চরম মুহূর্ত। কারণ, ততক্ষণে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে।
রাজারবাগের পাক হানাদার বাহিনীর মর্টার, গ্রেনেড আর ভারি অস্ত্রশস্ত্রের গুলি তখন কানে আসছে। একই সাথে কানে আসছিল রাজারবাগস্থ পুলিশের থ্রি নট থ্রি রাইফেলের গুলির শব্দ। তৎকালীন পুলিশের কাছে আধুনিক অস্ত্র ছিল না। বাঙালি জাতির মতো পুলিশও ছিল পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যের শিকার। পুলিশকে আধুনিক ঢালের পরিবর্তে বেতের তৈরি ধামার মতো দেখতে ঢাল দেয়া হতো। অস্ত্রের ক্ষেত্রে দেয়া হতো শুধু থ্রি নট থ্রি। রাজারবাগের হাজার হাজার পুলিশ এই থ্রি নট থ্রি দিয়েই যুদ্ধ করে আধুনিক আর ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে। পুলিশ ইচ্ছে করলে সেদিন পালিয়ে যেতে পারত।
কিন্তু তারা পালায়নি। বরং বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তারা উজ্জীবিত হয়েছিল পাক হানাদারদের রুখে দিতে। সমরাস্ত্রে তারা দুর্বল হলেও মানসিক শক্তিতে তারা ছিল সবল, উজ্জীবিত। এ জন্য পুলিশের সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রথম ধাক্কায় পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। তাদের কাছে ওই প্রতিরোধ ছিল সত্যিই অকল্পনীয়।
লিখেছেন, মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম, ‘পুলিশের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ ও একটি দেশপ্রেমের সূচনা’ হেডিংয়ে। … এই বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস নক্ষত্রময় সবকীর্তির এক মহাকাব্য। … ২৫ মার্চ কালরাতে রাজারবাগে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের প্রতিরোধ ছিল মুক্তিযুদ্ধে বীর বাঙালির প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ। …
বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের, ‘স্বাধীনতার সাহসী সৈনিকদের স্মরণে’ লেখায় বলেছেন, রাত প্রায় ১১টা। হঠাৎ করে কামানের গর্জন শোনা গেল। … পুলিশের বরাদ্দ করা ৩০৩ রাইফেল হাতে সবাই…। … শেষ বুলেটটি থাকা পর্যন্ত এবং তাদের মৃত্যুর না হওয়া পর্যন্ত তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ে যাবেন। …
তখন চামেলীবাগে অবস্থানরত বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহীন রেজা নূর লিখেছেন, স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে ১৯৭১ এর মার্চে পৌঁছালেই মানস-পর্দায় যে সকল দৃশ্য ভেসে ওঠে, এতকাল পরেও তা এতটুকু মলিন হয়নি। বরং যেন স্পষ্টই দেখতে পাই সেদিনের মানবজন্তুর সেই উন্মত্ত আস্ফালন তথা নারকীয়তা বীভৎস রূপটি। … আধুনিক সামরিক সম্ভারে সমৃদ্ধ পাক বরবরদের মোকাবেলায় ওই থ্রি নট থ্রি যে নস্যি একথা কারুর মাথায়ই নেই স্বাধীনতার উদ্বেল আকাঙ্ক্ষাজনিত কারণে আর দেশপ্রেমের চিত্ত প্রজ্জ্বলিত থাকার কারণে। …
চোখের জল ফেলে স্মৃতিকে বুকে জড়িয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ২৫ মার্চ রাতে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পুলিশবীরদের কথা ওঠে এসেছে।
যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পুলিশ সার্জেন্ট মো. মর্ত্তুজা হোসেন বলেন, পাকসেনারা প্রথমে মালিবাগ মোড়ের দিক থেকে পুলিশ লাইন্সে আক্রমন চালায়। প্রতিউত্তরে পুলিশ বাহিনীর হাতের রাইফেলগুলো একসঙ্গে গর্জে ওঠলে বহু পাকসেনা হতাহত হয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে পাকসেনারা হাতহতদের ট্রাকে উঠিয়ে পিছু হটে। … বীরাঙ্গনা রাবেয়ার কথা ওঠে এসেছে, তিনি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে সুইপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তার কথায়, পাঞ্জাবি সেনারা রাজাকার ও দালালের সাহায্যে রাজধানী স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং অভিজাত জনপদ থেকে বহু বাঙালি যুবতী, রূপসী মহিলা এবং সুন্দরী বালিকাদের জিপে, মিলিটারি ট্রাকে করে পুলিশ লাইন্সের বিভিন্ন ব্যারাকে জমায়েত করতে থাকে। … শুরু হলো ধর্ষকদের নারকীয় মহোৎসব। পাকিদের কেউ কেউ বালিকাদের দাঁড় করিয়ে দাঁড়ানো অবস্থায়ই…! আরও অনেকের স্মৃতিকথা ওঠে এসেছে নিপুণভাবে।
অসাধারণ তাদের সেই স্মৃতিকথা! এইসব লেখা পড়লে আপনার চোখের কোণায় ভেসে আসবে সেই ভয়াবহতা ও আমাদের বীরদের কথা। আর বইটি পড়া শেষ হলে মনে হবে, যেন যুদ্ধক্ষেত্র ঘুরে এলাম! মনে হবে আমিও তখন ছিলাম রাজারবাগ ময়দানে! তাই বলা যায়, বইটিতে যেসব লেখা ওঠে এসেছে, তা গল্পগ্রন্থ নয়, বাস্তব ঘটনার বর্ণনা। এ গ্রন্থে সংকলিত লেখাগুলোতে পাওয়া যাবে সেই প্রতিরোধের বীরত্বগাথা। প্রত্যক্ষদর্শী ও অভিজ্ঞ বিদগ্ধজনেরা অঙ্কন করেছেন তাদের স্মৃতির পটচিত্র। তাই দেশপ্রেম ও নিজেকে জাগ্রত করতে বইটি পড়া বিকল্প নেই।
উল্লেখ্য, ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’, বইটি সম্পাদনা করেছেন, হাবিবুর রহমান বিপিএম (বার), পিপিএম। ডিআইজি, বালাদেশ পুলিশ। প্রকাশক বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। পেপার ব্যাকে করা একশ বিরান্নবই পৃষ্ঠার বইটির মূল্য রাখা হয়েছে তিনশত টাকা, প্রকাশকাল জানুয়ারি ২০১৮। পরিবেশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড।
সুত্রঃবাংলাদেশ প্রতিদিন নেট।