আজ ৭ ডিসেম্বর মাগুরা মুক্ত দিবস। পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে মাগুরা জেলার প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাগুরার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। ২ মার্চ শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে তত্কালীন কোর্ট চত্ত্বরের সামনে বটতলায় (বর্তমানে পুলিশ সুপারের কার্যালয়) তত্কালীন মহকুমা প্রশাসক ওয়ালিউল ইসলাম আগুনঝরা বিপ্লবি বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যে মাগুরার মানুষের মাঝে ব্যাপক উদ্দিপনার সৃষ্টি হয়। এ সময় তাত্ক্ষণিক ভাবেই ছাত্রলীগ সভাপতি মুন্সী রেজাউল হককে সভাপতি করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং এড. আসাদুজ্জামানকে আহ্বায়ক এবং ওয়ালিউল ইসলামকে সদস্য সচিব করে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়। পরবর্তীতে এ দুটি পরিষদ গঠনের পর থেকেই তারা ঢাকার ঘোষণা অনুযায়ী মাগুরাতেও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে এবং ৩ মার্চ মাগুরায় সফল হরতাল পালন করে। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান অন্যতম দুই উপদেষ্টা আতর আলী এবং এড. সোহরাব হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে ২৫ মার্চ পর্যন্ত এ অসহযোগ আন্দোলন অব্যহত রাখেন। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গেরিলা তত্পরতা চালাতে উলেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এড.আবুল খায়ের, আলতাফ হোসেন, নবুয়ত মোল্যা, আবু নাসের বাবলু, নন্দ দুলাল বংশী প্রমুখ।
এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার পর পাকিস্তানী সেনা বাহিনী সারা দেশে হত্যযজ্ঞ শুরু করলেও সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ২৬ মার্চ মাগুরার প্রবেশ পথ গুলোতে নানারকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে এক কঠিন প্রতিরোধ ব্যুহ তৈরী করতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি তারা স্থানীয় ভাবে প্রয়োজনীয় অর্থ, অস্ত্র ও সদস্য সংগ্রহ করতে থাকে।
১২ মার্চ তারা ঝিনাইদহ এসডিপিও মাহবুব এর সহযোগিতায় মাগুরা থানা লুট করে বেশ কয়েকটি অস্ত্র সংগ্রহ করে। ২৬ মার্চ চুয়াডাঙ্গা ইপিআর এর ৪ নং উইং কমাণ্ডার মেজর ওসমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং ১ প্লাটুন সদস্যকে অস্ত্রসহ মাগুরার সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগ দিতে প্রেরণ করেন যা পরবর্তীতে ব্যপক সহায়ক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।
সংগ্রাম পরিষদ মাগুরা নোমানী ময়দানস্থ আনসার ক্যাম্পের টিনের ঘরটিকে তাদের প্রধান কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করতে থাকেন। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণেচ্ছু ছাত্র জনাতাকে সংঘটিত করে নোমানী ময়দান, পারনান্দুয়ালী শেখপাড়া আমবাগান, ওয়াপদা, সদর উপজেলার কাটাখালী ব্রিজের পাশে সহ বিভিন্ন স্থানে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় হাবিলদার সাজাহান, কামরুজ্জামান (শৈলকুপা), হারেসার, জাহিদুল ইসলাম মিটুল, আকবর হোসেন, জাহিদুল ইসলাম (বেলনগর), আঃ ওয়াহেদ মিয়া (পারনান্দুয়ালী), আঃ মান্নান প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ৪ এপ্রিল তাজুদ্দিন আহম্মেদ এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম মাগুরার সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয় এবং ঐদিন রাতে সংগ্রাম পরিষদ তাদেরকে মাগুরা থেকে ভারতের পথে এগিয়ে দিয়ে আসে। এ দিনেই মাগুরা-যশোর সড়কের লেবু তলায় পাক বাহিনীর সাথে সুবেদার আঃ মুকিতের নেতৃত্বে মাগুরা সংগ্রাম পরিষদের ব্যপক সম্মুখ যুদ্ধের সৃষ্টি হয় যা ৭ এপ্রিল পর্যন্ত দফায় দফায় চলতে থাকে।
এ যুদ্ধে শহরের পারনান্দুয়ালী গ্রামের শরিফুল ইসলাম ফুলসহ ১৫ জন নিহত হয়। সম্ভবত শরিফুল ইসলামই মাগুরার প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। এদিকে ১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে শপথ গ্রহণের পর এড.আসাদুজ্জামান এমপি রানাঘাটে ক্যাম্প ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য ভারত গমন করেন।
মাগুরা সংগ্রাম পরিষদ বিশাল প্রতিরোধ ব্যবস্থা অব্যহত রাখলেও ২২ এপ্রিল সোমবার দুপুরে পাক সেনাবাহিনী বিশাল ট্যাঙ্ক বহর নিয়ে ঝিনাইদহ ও যশোর সড়ক দিয়ে মাগুরা সীমানায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। এদিন মাগুরার আলমখালী বাজার এলাকায় সুরেন বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তিকে পাক সেনারা গুলিতে নিহত করে এবং পরদিন ২৩শে এপ্রিল মঙ্গলবার জয় বাংলা শ্লোগান দেওয়ায় পাক সেনাবাহিনী বাগবাড়িয়া গ্রামের লালু নামে এক পাগলকে গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে হানাদাররা শহরের পিটিআই, ভিটিআই, সিও অফিস (বর্তমান উপজেলা পরিষদ চত্ত্বর, মাগুরা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, নিউ কোর্ট বিল্ডিং, মাইক্রোওয়েভ স্টেশন ও মাগুরা সরকারি কলেজে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। শহরের মধুমতি ডাক বাংলোটিকে তারা হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করে কার্যক্রম পরিচালনা করে। পাক বাহিনী স্থানীয় ক্ষধীনতা বিরোধীদের চিহ্নিত করে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে তাদের যোগসাজসে নারকীয় হত্যাযজ্ঞসহ বর্বর হামলা আক্রমন চালিয়ে যেতে থাকে। মেজর হায়াত এবং মাগুরার রিজু, কবির, পীর ওবায়দুলাহ, বাশি চেয়ারম্যান ও আয়ুব চৌধুরীদের সেই সময়কার পৈচাশিক হত্যযজ্ঞ ও বিভিষিকার কথা মাগুরার মানুষের মনে এখনো জ্বলজ্বল করে।
এ সময় মাগুরার আকবর বাহিনী, মহম্মদপুরের ইয়াকুব বাহিনী, মোহাম্মদপুর-ফরিদপুর অঞ্চলের মাশরুরুল হক সিদ্দিকীর কমল বাহিনী, মাগুরা শহরের খোন্দকার মাজেদ বাহিনী এবং মুজিব বিশেষ সাহসী ভুমিকা নিয়ে পাক সেনাদের ও স্থানীয় রাজাকার-আল বদর বাহিনীর সাথে প্রাণপন যুদ্ধ করে। এ সময় কমল বাহিনীর প্রধান মাশরুরুল হক সিদ্দিকী কমল ভাটিয়াপাড়র এক সম্মুখ যুদ্ধে গুলিতে তার একটি চোখ হারান। শ্রীপুর বাহিনী রণাঙ্গণে একের পর এক বিরোচিত অভিযানে পাক হানাদার বাহিনীতে তটস্থ করে তোলে। শ্রীপুরের শ্রীকোল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আকবর হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ বাহিনী মূলত মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর এলাকা জুড়ে তত্পরতা চালায়। এ বাহিনীর অব্যাহত অভিযান ও স্থানীয় গেরিলা বাহিনীর তত্পরতায় পাক বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। এ দুই বাহিনী ৬ ডিসেম্বর মাগুরাকে হানাদার মুক্ত করতে নিজনান্দোয়ালী গ্রামে ও বিভিন্ন পাকিস্তানি ক্যাম্পে একই সময়ে আক্রমন চালায়। একই সাথে মিত্র বাহিনীর আগ্রাসনের ভয়ে পাকিস্তাানি সেনারা রাতারাতি মাগুরা শহরে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
পরদিন ৭ ডিসেম্বর মাগুরা হয় শত্রুমুক্ত। হানাদার মুক্ত হওয়ার আনন্দে মুক্তিকামী মানুষের ঢল নামে সারা শহরে। জয় বাংলা, জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা শহর।
দিবসটি উপলক্ষে এ বছর মাগুরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বর্ণাঢ্য র্্যালি , আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।