পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন তার কার্যক্রমের এক বছর পূরণ করল। এই এক বছরে কার্যক্রমটি ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন পরিষেবাটি নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযোগ গ্রহণ করে এবং অভিযোগকারীদের প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত ও আইনি পরামর্শ দিয়ে থাকে। সাইবার বুলিং, ট্রলিং, পরিচিতি তথ্য অপব্যবহার ও প্রকাশ, ব্লাকমেইলিং, রিভেঞ্জ পর্নোসহ বিভিন্ন উপায়ে সাইবার স্পেসে যত হয়রানির ঘটনা ঘটে, সেসবের প্রধান শিকার হন নারীরা। ভুক্তভোগী নারীরা অধিকাংশ সময় বুঝতে পারেন না কীভাবে, কী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং কাকে বিষয়টি জানাবেন। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারকে জানাতে বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তার কাছে তাঁরা অভিযোগ জানানোর ব্যাপারে সংকোচ বোধ করেন। এই নারীদের পাশে দাঁড়াতে ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন যাত্রা শুরু করেছিল। ‘নারীর জন্য নিরাপদ সাইবার স্পেস নিশ্চিতকরণ’এ রূপকল্প নিয়ে পরিষেবাটি চালু হয়েছিল। সাইবার স্পেসে নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে প্রযুক্তিগত ও আইনি সহায়তা দেওয়া এবং সাইবার নিরাপত্তা-সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি করাই এ সেবার মূল উদ্দেশ্য।

ভুক্তভোগী নারীরা যাতে সহজেই তাঁদের হয়রানির বিষয়টি জানাতে যোগাযোগ করতে পারেন, সে জন্য এ সার্ভিসের একটি হটলাইন নম্বর (০১৩২০-০০০৮৮৮) রয়েছে। এ ছাড়া তাদের সমস্যা পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন-এর ফেসবুক পেজে মেসেজ পাঠিয়ে এবং ইমেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করেও জানাতে পারেন।

বিগত এক বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কার্যক্রম শুরুর পর ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন-এর সঙ্গে মোট ১৭ হাজার ৭৭০ জন সেবাপ্রত্যাশী যোগাযোগ করেছেন। তাঁদের মধ্যে ১২ হাজার ৯৪১ জন ভুক্তভোগী নারী সাইবার স্পেসে হয়রানির সমাধান পেতে যোগাযোগ করেছেন। ৮ হাজার ৩৩১ জনের অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত ও আইনগত পরামর্শ এবং সহায়তা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যেসব পন্থায় নারীদের সাইবার স্পেসে হয়রানি করা হয়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুত্ব স্থাপন ও কথোপকথনের মাধ্যমে ছবি, ভিডিও ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করে ব্ল্যাকমেইল করা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীর ব্যক্তিগত ছবি/ভিডিও বা পরিচিতি তথ্য প্রকাশ করে হয়রানি করা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপত্তিকর ছবি পাঠিয়ে বা আপত্তিকর ভাষায় নারীকে মেসেজ পাঠিয়ে হয়রানি করা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইডি হ্যাক করে তাতে থাকা ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করে ব্ল্যাকমেইল করা।
মোবাইল ফোনে কল করে হয়রানি।

অভিযোগকারীরা আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাইলে প্রাথমিকভাবে প্রযুক্তিগত তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে অভিযুক্তকে শনাক্ত করা হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট পুলিশ ইউনিটের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে ভুক্তভোগীকে সহায়তা দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি নারীদের মধ্যে সাইবার সচেতনতা বাড়াতে এ পরিষেবা নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ভুক্তভোগী নারী যাতে দ্বিধাহীনভাবে ও নির্বিঘ্নে তাঁর অভিযোগ জানাতে পারেন, সে জন্য এই সেবার সব পুলিশ সদস্য নারী।

সাইবার অপরাধ বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, সাইবার স্পেসে পরিচয় লুকানো সহজ। এর মাধ্যমে যেকোনো স্থানে বসে শুধু ইন্টারনেট ব্যবহার করে অপরাধ করা যায়। সামাজিক যোগাযোমাধ্যমে কোনো তথ্য প্রকাশিত হলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে নিত্যনতুন ডিভাইস ও অ্যাপস ব্যবহার করে সাইবার অপরাধ সংঘটন করা যায়।

প্রাপ্ত অভিযোগের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া আইডি ব্যবহার করে হয়রানি করার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি, যা মোট অভিযোগের ৪৩ শতাংশ। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন-এ বিভিন্ন বয়সী নারী ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। তাঁদের মধ্যে মোট অভিযোগকারীর ১৬ শতাংশ ভুক্তভোগী ১৮ বছরের কম বয়সী। ৫৮ শতাংশ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর। ২৪ বছর থেকে ৩০ বছর বয়সী ভুক্তভোগী ২০ শতাংশ এবং ৬ শতাংশ ভুক্তভোগীর বয়স ৩০ বছরের বেশি।

উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগ থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক ভুক্তভোগী (মোট অভিযোগের ৬৪ শতাংশ) এবং চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে ১৭ শতাংশ ভুক্তভোগী পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগ থেকে ৪ শতাংশ করে ভুক্তভোগী যোগাযোগ করেছেন। বরিশাল থেকে ৩ শতাংশ এবং রংপুর ও ময়মনসিংহ থেকে ২ শতাংশ করে ভুক্তভোগী যোগাযোগ করেছেন।

পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন নিয়মিত হটলাইনে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে কল পেয়ে থাকে। এখানে সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার ভুক্তভোগী নারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা তাঁদের অভিযোগ জানান। হটলাইন নম্বরে কলের মাধ্যমে সমস্যা শোনা হয় এবং আইনগত প্রক্রিয়া সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া হয়। এটি ভুক্তভোগীদের জন্য।

লেখক : ড.বেনজীর আহমেদ বিপিএম-বার, ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ।





০ মন্তব্য

আরও পোস্ট পড়ুন

মতামত দিন