রুপমায়া ঘেরা সবুজ-শ্যামল-বিস্তৃত সাতক্ষীরার মনোরম পরিবেশের কিছুই তাঁকে টানত না। তাঁর মন সারাক্ষণ পড়ে থাকত খেলার মাঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বন্ধুরা যখন ক্যারিয়ার গড়তে বিসিএসের হলে বসছেন, তৈয়েব হাসান তখনও ব্যস্ত রেফারিং এর নিয়মকানুন শিখতে। আর রেফারিং শিখেই সাতক্ষীরার মাঠ পেরিয়ে কোয়ালিফায়িং সহ শতাধিক ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনার মাধ্যমে রেকর্ড গড়েছেন তৈয়ব হাসান। আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া সব ধরনের রেফারিং থেকেই প্রায় দুই বছর আগে অবসরে গেছেন তিনি। তাঁর পুরো নাম তৈয়ব হাসান শামসুজ্জামান বাবু হলেও তাকে সাংবাদিক, ডাক্তার কিংবা সকল-শ্রেণি-পেশার মানুষ চেনেন তৈয়ব হাসান নামে। এ নামেই তাঁর বিশ্ব তথা এশিয়াজুড়ে খ্যাতি ও পরিচিতি। এশিয়ার খেলাপ্রেমীদের প্রিয় মুখ রেফারি তৈয়ব হাসান ১৯৭০ সালের ৯ জানুয়ারি সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মরহুম আব্দুস সবুর ও মাতার নাম সৈয়দা খানম। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই কন্যা জনক।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষকতার পাশাপাশি দেশে-বিদেশে রেফারিং এ সার্টিফিকেট কোর্স এবং রিপোটিং কোর্স সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করার পর তৈয়ব হাসান যদিও কলেজে যোগদান করেছিলেন, কিন্তু সেটাই তার প্রধান কর্মের স্থান হলেও প্রধান পরিচয়টা গড়ে ওঠেনি একজন শিক্ষক হিসেবে। তিনি দিনে দিনে, কালে কালে হয়ে উঠেছেন একজন আন্তর্জাতিক মানের কিংবদন্তী ফিফা রেফারি হিসেবে। প্রায় নব্বই এর দশকে পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে খেলা নিয়ে লিখে একটা মৌলিক পরিবর্তন এনেছিলেন। কিন্তু তাকে পিছু হাঁটতে হয়নি কখনও। তাই, এএফসির এলিট প্যানেলে রামকৃষ্ণের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি রেফারি হিসাবে নিজের অবস্থান করে নিয়েছিলেন তৈয়ব হাসান। একসময় এশিয়ার সেরা ২৫ রেফারির তালিকায়ও ছিলেন তিনি।
ছোটবেলায় স্কুলে ১০০ ও ২০০ মিটারে দৌঁড়াতেন। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও একাধিকবার অংশ নিয়েছিলেন। তবে ফুটবলটাই ছিল তৈয়েব হাসানের ধ্যানজ্ঞান। ১৯৮৩ সালে সাতক্ষীরা শহরে রেফারিং শুরু করলেও এসএসসি পাশের পরে দৈনিক কাফেলার মাধ্যমে সংবাদপত্রে লেখালেখি শুরু করেন। এবং এইসএসসি পাশের পরে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন ১৯৮৯ সালে। সে সময় সাপ্তাহিক দক্ষিণায়নেও লিখতেন। ১৯৯২ সালে দৈনিক আজাদ পরবর্তীতে দৈনিক জনকন্ঠের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৯৪ সালে সাতক্ষীরা দিবা নৈশ কলেজে যোগদানের মধ্য দিয়ে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। তবে ১৯৯৭ সালে ঢাকা ফিজিক্যাল কলেজ থেকে বিপিএড, উত্তরা ইউনিভার্সিটি থেকে এমপিএড এবং ডি.বি.খান হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতাল থেকে ডিএইচএমএস পাশ এর পাশাপাশি ফিফা রেফারিং হিসাবে ম্যাচ পরিচালনা শুরু করেছিলেন ১৯৯৯ সাল থেকে। এর কিছুদিন পরই ফিফার এলিট প্যানেলে যুক্ত হয়ে ফিফা আয়োজিত বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়িং, অলিম্পিক কোয়ালিফায়িং, এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ, বিভিন্ন রাউন্ড টুর্নামেন্টসহ শতাধিক আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করলেও রেফারিং জীবনে এএফসি চ্যাস্পিয়ন্স লীগে জাপান-কোরিয়া, এশিয়ান কাপ কোয়ালিফাইং, উজবেকিস্তান, আরব-আমিরাত, উত্তর কোরিয়া-জাপান ম্যাচ এবং ২০১৩ সাফ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনাই উল্লেখযোগ্য ছিল তার সর্বশেষ ম্যাচ। তিনিই সাউথ এশিয়ান হিসাবে প্রথম ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করেছিলেন। এসমস্ত ম্যাচ পরিচালনায় তিনি কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, হংকং, তাইয়ান, চীন, মঙ্গোলিয়া, ইরান, ইরাক, মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাউস, জর্ডান, ওমান, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান, তাজাকিস্থানসহ এশিয়ার প্রায় সব দেশে ফিফা, এএফসি এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সে হিসেবে তার গুণমুগ্ধ ভক্তদের সংখ্যা অগণিত। রেফারিংয়ে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তিনি একমাত্র বাংলাদেশী হিসাবে এশিয়ান ফুটবল কনফিডারেশন (এএফসি), বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে), সাতক্ষীরা জেলা জন সমিতি-ঢাকা, সোনালী অতীত ক্লাব-ঢাকা, বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি, বাংলাদেশ স্পোটস জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন সহ বিভিন্ন জাতীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সেরা রেফারিং এ সম্মাননা পেয়েছেন। এবং এশিয়ান ফুটবল কনফিডারেশন (এএফসি) এর তৎকালীন প্রেসিডেন্টও তাঁকে সম্মাননা প্রদান করেছিলেন। কিন্তু আজও রাষ্ট্রীয় কোন স্বীকৃতি পাননি তৈয়ব হাসান।
সূত্রঃভয়েজ অফ সাতক্ষীরা ডটকম।





০ মন্তব্য

আরও পোস্ট পড়ুন

মতামত দিন