বিদায় খুলনা
হে বন্ধু বিদায়
গল্পের শেষ আছে, কবিতার শেষ আছে, উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠা রয়েছে, যেতে যেতে নদীও একদিন সাগরে মিশে। কিন্তু জীবনের বিচিত্র অনুভবের শেষ নেই, মৃত্যু নেই, হীরার কুচির মতো দীপ্তি ছড়ায়ে বেঁচে থাকে।
দক্ষিণ পশ্চিম জনপদে জীবনের ছয়টি বছর অতিক্রম করলাম। কমিশনার হিসেবে তিন বছর ষোল দিন, জেলা প্রশাসক, সাতক্ষীরা হিসেবে প্রায় তিন বছর। মনে হলো কাল যেন কাজ শুরু করেছিলাম। নাজিম হিকমতের ‘আমি জেলে যাবার পরে’ কবিতার ভাষায়,
‘আমি যখন জেলে এলাম
এক হপ্তায় একটি পেন্সিল খুয়ে ফেলেছিলাম
আমার কাছে যদি জিজ্ঞাসা করো
আমি বলবো এ আর এমন কি
এক হপ্তা,
আর পেন্সিলকে যদি জিজ্ঞাসা করো
সে বলবে আমার গোটা জীবন।’
আদিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ, সবুজ বৃক্ষরাজি, আমের বাগান, পীত রঙের সীম, করলার বাগানের ফুল, বৈচিত্র ফসল, ফলের রূপ রস, ভৈরব, রূপসা, কপোতাক্ষ, মাথাভাঙ্গা, গড়াই, পদ্মা, খোলপেটুয়া, চিত্রানদীর শাশ্বত রূপ যৌবন দেখতে দেখতে চলে গেল জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ছয় বছর।
আমি আনন্দিত মানুষের জন্য কিছুটা করার চেষ্টা করেছি।
১। ১১৪৪ টি উদ্ভাবন প্রকল্প।
২। শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবকদের দু’বার বিভাগীয় কমিশনার স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্রপদক প্রদান ও অন্যান্য সম্মাননা প্রদান।
৩। Administrative Convention Center নির্মাণের DPP অনুমোদন চূড়ান্ত পর্যায়।
৪। বিভাগীয় কমিশনারের নতুন অফিসভবন নির্মাণের DPP দাখিল পরিকল্পনা কমিশনে। অফিসের নান্দনিক গেট নির্মাণ, অফিস কক্ষ সজ্জিতকরণ। বাংলোকে নতুনরূপে সাজানো।
৫। খুলনা বিভাগে ভিক্ষুকমুক্তকরণ, ভিক্ষুকদের কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসন।
৬। ২২ টি ইকোপার্ক স্থাপন। ১৫০ বিঘা জায়গায় খুলনার শেখ রাসেল ইকোপার্ক নির্মাণের কাজ শুরু।
৭। জৈব কৃষিকে উৎসাহদান। ফরমালীনমুক্ত আম উৎপাদন।
৮। Day Care Center স্থাপন। Brest Feeding Corner স্থাপন।
৯। ভূমি অফিসের Digitalization.
১০। শিক্ষার উন্নয়ন, কোচিং বন্ধ, মিড ডে মিল চালু।
১১। মোংলা ঘষিয়াখালী চ্যানেল খনন।
১২। কপোতাক্ষ নদ আংশিক খনন, পাখিমারা বিলে টি আর এম।
১৩। নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু অধিকার নিশ্চিতকরণ, বাল্য বিবাহ নিরোধ।
১৪। সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন চর্চাকে বিকশিত করার অজস্র কর্মসূচী নেয়া হয়েছে।
১৫। ১০০% সততার সাথে কর্মচারী নিয়োগ।
এরকম বহু কাজ আমরা সহকর্মীদের সহায়তায় করেছি।
আমাদের এই কাজে আমার সকল সহকর্মী, সম্মানিত জনপ্রতিনিধি, সুধীজন, মিডিয়ার সহকর্মীরা, খুলনার সম্মানিত জনগণ, বিভিন্ন সংগঠন সহায়তা প্রদান করেছেন তাঁদেরকে অশেষ ধন্যবাদ।
আল্লাহর রহমতে আমি সচিব, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। আমি জানি শৈশব থেকে এ পর্যন্ত বহু মানুষের পরিশ্রম, দোয়া ও ভালবাসায় আমার জীবন বিস্তৃত হয়েছে।
আজ চলে যাওয়ার মুহুর্তে অজস্র স্মৃতি, স্মৃতি কাতর করছে। আনন্দের স্মৃতি ও কষ্টের স্মৃতি। সোনার খাঁচার দিনগুলি চির জাগরূপ হয়ে থাকবে। নক্ষত্রের রূপালী আগুন ভরা রাতের দক্ষিন-পশ্চিম জনপদে থাকা সৌন্দর্য চিরদিন আমার মনে থাকবে। লক্ষ মানুষের বিচিত্র জীবন। আনন্দ বেদনার অনুরণন
‘রূপ-নারানের কূলে
জেগে উঠিলাম;
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ–
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম–
সে কখনো করে না বঞ্চনা।
ফিরে যাচ্ছি ‘‘ছুটি’’ গল্পের বলাইয়ের মতো গ্রাম ছেড়ে মোঘলদের তৈরী করা শহরে। দিয়ে গেলাম নাটাই আর ঘুড়ি সহকর্মীদের। হয়তো এই চলে যাওয়া অবস্থানগত বা শারীরিক।
তবু জীবন এক বহতা নদী। জীবন কখনো থেমে থাকে না। যা অনিবার্য তাকে সাদরে গ্রহণ করতে হবে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো গলা ফাটিয়ে আকাশ কাঁপিয়ে আমার সাহস নেই সেই গানটি বলার :-মহ
‘‘পৃথিবী তোমায় যাই জানিয়ে, আমি চলে গেলেও আমার গান বেঁচে থাকবে।”
তবু জীবনকে ভালবেসে গান হোক আমাদের জীবন।
কোন মহৎ কাজ, চেষ্টা, উদ্যোগ নষ্ট হয় না। মহান স্রষ্টা তা রক্ষা করেন আমার বিশ্বাস। কাজেই প্রিয় খুলনা বিভাগবাসী, প্রিয় সহকর্মী আসুন-
আমাদের মেধা, প্রজ্ঞা, শক্তি দিয়ে দেশকে গড়ে তুলি। দেশের মানুষকে সহয়তা করি।
ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা বাংলাদেশ বিনির্মাণ করি।
নিশ্চয়ই আবারো দেখা হবে —।
তবু প্রিয় খুলনা। হে বন্ধু, বিদায় ! বিদায় !! বিদায় !!!
লেখক:জনাব মো:আবদুস সামাদ,সচিব,নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়,বাংলাদেশ।