পুলিশ বিভাগে শেষ হতে চলেছে তদবির, সুপারিশ আর বাণিজ্যের মাধ্যমে নিয়োগের দিন! পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, বিপিএম (বার) দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের কনস্টেবল পদে নিয়োগে চলে আসা ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের অ্যাকশন শুরু করার ঘোষণা দেওয়ায় চরম আতঙ্ক তৈরি হয়েছে বাহিনীর ভেতরে-বাইরে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে পুলিশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তার এমন হুঙ্কারে নড়েচড়ে বসেছেন দায়িত্বশীলরাও। এমনিতেই আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ১০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগে বাণিজ্য বন্ধে সর্বোচ্চ কঠোর হয়ে শক্ত ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন তদবিরবাজ ও নিজ বাহিনীর এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের।

এতে করে ছাই পড়েছিল নিয়োগ বাণিজ্যের স্বপ্নে বিভোর জনপ্রতিনিধি, আমলা, রাজনৈতিক দলের আতি-পাতি নেতা থেকে শুরু করে মধ্যম সারির নেতা, গণমাধ্যমকর্মী বা প্রভাবশালীদের মুখে। নিজের সময়কার পুলিশ কনস্টেবল পদে দ্বিতীয় নিয়োগেও এ পুলিশ প্রধান চান স্বচ্ছ আর মেধানির্ভর নিয়োগ।

পাশাপাশি ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুন্যের কোঠায় নামিয়ে এনে তিনি পুলিশের বহুদিনের দুর্নাম ও অপবাদ ঘুচানোর প্রয়াস নিয়েছেন। আইজিপির এমন অনড় অবস্থানে তাঁর ‘মনের মতো’ আর্থিক বাণিজ্যহীন নিয়োগ উপহার দিয়ে নজির স্থাপন করতে আঁটঘাট বেঁধেই মাঠে নেমে পড়েছেন জেলার পুলিশ সুপাররাও (এসপি)।

পুলিশ প্রধান প্রতিটি রেঞ্জ ডিআইজি ও এসপিদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রার্থীদের কাছ থেকে যেন কোনোভাবেই ১০৩ টাকার বেশি নেওয়া না হয়। এরপর থেকেই কনস্টেবল নিয়োগের ‘অধিকর্তা’ জেলার পুলিশ সুপাররা (এসপি) প্রায় প্রতিদিনই নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধে দালাল আর প্রতারক ঠেকাতে নিজ নিজ এলাকায় জনসচেতনতা তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

নিজেরাই ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন করে জানান দিচ্ছেন মাত্র ১০৩ টাকায় মিলবে কনস্টেবল পদে চাকরি! এ নিয়ে তাদের মাঝে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবতার এমন অমিলে মাথায় হাত পড়েছে দালাল ও প্রতারকদের।

জানতে চাইলে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হাবিবুর রহমান প্রতিবেদক কে বলেন, ‘পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে নজিরবিহীন নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা হচ্ছে। কোন রকমের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি যেন না হতে পারে সেজন্য কমিটির সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। স্বচ্ছতা বজায় রেখে নিয়োগ প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আইজিপি মহোদয় প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।’

জানা যায়, প্রায় মাসখানেক আগে মাধ্যমিক পাশে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে ৯ হাজার ৬৮০ জনকে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ পুলিশ। এর মধ্যে ৬ হাজার ৮০০ জন পুরুষ এবং ২ হাজার ৮৮০ জন নারীকে নিয়োগ দেওয়া হবে।

ঢাকা রেঞ্জের মাদারীপুর ও রাজবাড়ী, চট্টগ্রাম রেঞ্জের চাঁদপুর, রাজশাহী রেঞ্জের নাটোর, রংপুর রেঞ্জের নীলফামারী, বরিশাল রেঞ্জের পিরোজপুর ও বরগুনা জেলায় শারীরিক মাপ ও শারীরিক পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে শনিবার (২২ জুন) থেকে শুরু হয়েছে এ নিয়োগ। পর্যায়ক্রমে সব জেলাতেই চলছে নিয়োগ প্রক্রিয়া। এ নিয়োগ শেষ হবে আগামী মঙ্গলবার (৯ জুলাই)।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগের আইজিপি এ কে এম শহীদুল হকের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগমুহুর্তে ব্যাপক ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১০ হাজার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর ২০১৮ সালের প্রথম দিকে ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী পুলিশের নেতৃত্বে আসার পর সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু হয়।

ওই নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্য বন্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন পুলিশের এ সর্বোচ্চ কর্মকর্তা। ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগের অভিযোগ পেলে নিজ বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর বিভাগীয় ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি, পুলিশ সদর দফতরের মনিটরিং টিমসহ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নিয়োগে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে চমক তৈরি করেন পুলিশের আইজি।

গতবারের মতো এবারো নৈতিকতার শক্তি দিয়েই স্বচ্ছতার মাপকাঠিতেই নিয়োগ নিশ্চিত করতে চান পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। ক’দিন আগে পুলিশ সদর দফতরে ত্রৈমাসিক অপরাধ সভায় নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে তিনি এসপিদের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে স্পষ্টই জানিয়ে দেন ঘুষ দিয়ে কাউকে নিয়োগ দিলে এবং সেই অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহার এমনকি বরখাস্ত করা হবে।

পুলিশের ময়মনসিংহ রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) নিবাস চন্দ্র মাঝি প্রতিবেদক কে বলেন, ‘আইজিপি মহোদয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সারা দেশেই কনস্টেবল নিয়োগ অত্যন্ত সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে হবে। যে জেলায় অনিয়ম হবে সেই জেলার এসপির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পুলিশ সদস্য ব্যতীত অন্য কেউ একই কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেলে তাঁর বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন আইজিপি।’

পুলিশ সদর দফতরের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রতিবেদক কে বলেন, ‘বৃহস্পতিবারও (২০ জুন) পুলিশ সদর দফতর থেকে পাঠানো বার্তায় পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের তথ্য পেলে নিয়োগ বাতিলসহ আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে।

নিয়োগে সদর দফতর থেকে প্রতি জেলার জন্য একজন পুলিশ সুপারের (এসপি) নেতৃত্বে একটি করে তদারকি টিম রয়েছে। পরীক্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই টিমগুলো সবগুলো জেলায় সফর করছে। আর্থিক লেনদেনে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হলে এসপি হলেও তিনি ছাড় পাবেন না। তদারকি টিম তাঁর বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

এ বিষয়ে যশোর জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মঈনুল হক প্রতিবেদক কে বলেন, ‘কেবলমাত্র মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই চাকরি হবে। এখানে কোন প্রকার আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি যাতে না হয় সেটা আমরা শতভাগ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করবো। আইজিপি স্যারের নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালনের জন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। তদবির বা সুপারিশ প্রার্থীর অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হবে।’

টাঙ্গাইল জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) সঞ্জিত কুমার প্রতিবেদক কে বলেন, ‘যোগ্যতার ভিত্তিতে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। আর এক্ষেত্রে খরচ হবে মাত্র ১০৩ টাকা। এ টাকার মধ্যে ৩ টাকা ফরমের মূল্য আর ১০০ টাকা সরকার নির্ধারিত পরীক্ষার ফি বাবদ ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে ব্যাংক ড্রাফট করতে হবে।’

কোনো ধরনের ঘুষ-দুর্নীতি ও তদবির ছাড়াই ১০০ টাকায় পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছেন বগুড়া জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আলী আশরাফ ভূঁইয়া। গতবারও ফ্রি এন্ড ফেয়ার নিয়োগে তাঁর হাত ধরে কুলি, শ্রমিক ও ভ্যানচালকের সন্তানেরাও চাকরি পেয়েছিলেন। এবারো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার আগে ও পরে নানা স্টাইলে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এসপি আলী আশরাফ ভূঁইয়া প্রতিবেদক কে বলেন, ‘জেলার ১২ থানায় মানুষকে জানান দিতে জেলার পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যাপকভাবে লিফলেট বিতরণ ও পোস্টারিং করা হচ্ছে। আইজিপি মহোদয়ের নির্দেশনা মোতাবেক ঘুষ-দুর্নীতি মুক্ত এবং শতভাগ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগ দেওয়া হবে।’

সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মো:সাজ্জাদুর রহমান,খুলনার পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ,কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার তানভীর আরাফাত,মেহেরপুরের পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান, বাগেরহাটের পুলিশ সুপার (এসপি) পঙ্কজ চন্দ্র রায় ও নড়াইল জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) জসিম উদ্দিন,মাগুরার পুলিশ সুপার খান মোহাম্মদ রেজোয়ান,গোপালগজ্ঞের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ সাইদুর রহমান খান সহ দেশের প্রায় প্রতিটি পুলিশ সুপারই (এসপি) বলছেন, ‘নিয়োগ প্রত্যাশীরা শুধু সরকার নির্ধারিত ১০৩ টাকা খরচ করলেই হবে। অতিরিক্ত কোনও টাকা খরচ করতে হবে না।’

পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশে ইতিবাচক ধারার সূচনা করেছেন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী। তিনি বাহিনীর ইমেজ পুনরুদ্ধারের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে তিনি প্রতিটি সদস্যকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনার চেষ্টা করছেন। নিজের পরিচ্ছন্ন ইমেজের কারণেই বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের কাছেই তিনি অম্লান আদর্শ।’

আইজিপিকে পরিপূর্ণভাবে চিনেন এবং তাঁর সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখেন এমন সচেতন নাগরিকরা বলছেন, ‘দূর্ণাম ও অপবাদ ঘুচিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সুমহান চেতনায় গড়ে উঠা পুলিশ বাহিনীকে মর্যাদার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে কৃত্রিমতা ও লোক দেখানো ভালোত্ব বর্জন করে সরল, সোজা ও সত্যের পথকে বেছে নিয়েছেন পুলিশের আইজি জাবেদ পাটোয়ারী।’

একবাক্যে তাঁরা বলছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গাইড লাইন’ আর যাদুকরী স্পর্শে আইজিপি নিজের ক্লিন ইমেজে গোটা পুলিশ বাহিনীকে উদ্বেলিত করেছেন পুনরুজ্জীবনের মহামন্ত্রে। জাবেদ পাটোয়ারীর নেতৃত্বেই নতুন বিশুদ্ধ রক্ত সঞ্চালন হবে পুলিশে।

কারণ নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে একজন পুলিশ সদস্য চাকরিতে যোগ দিলে পরবর্তীতে তাঁর খেসারত গুনতে হয় গোটা বাহিনীকেই। এজন্যই যোগ্য ও মেধাবীদের চাকরি নিশ্চিত করার মাধ্যমে তিনি উজ্জ্বল করতে চান নিজ বাহিনীর ভাবমূর্তি। মসৃণ করতে চান নিজ বাহিনীর সদস্যদের সামনের পথচলা।

বিশ্লেষকরা মনে করে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বার বার লড়াই করার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুলিশে দুর্নীতি বন্ধের পাশাপাশি গুণগত পরিবর্তন আনতেই নেতৃত্ব তুলে দিয়েছেন বিচক্ষণ, সততা এবং আন্তরিকতা রয়েছে এমন মানুষ ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর হাতে।

তাঁরই ধারাবাহিকতায় দুর্নীতি রোধে সব সময়ই নিজের অমিত দৃঢ়তা ও সদিচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে এ পুলিশ প্রধানের বক্তব্যে। এবার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শতভাগ স্বচ্ছতা বজায় রাখার মাধ্যমে ঠিকই তিনি আবারো সাফল্যের নজির স্থাপন করতে সক্ষম হবেন।

বঙ্গবন্ধুর পুলিশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অনুপ্রেরণাই এক্ষেত্রে তাঁর জন্য কাজ করতে পারে টনিক হিসেবে। দুর্নীতির কলঙ্কমুক্ত পুলিশ উপহার দিয়েই দেশপ্রেমিক বাহিনীতে চিরজাগ্রত থাকবেন পুলিশের এ আইজি। কথায় নয় বাস্তবেও বদলে দিতে সক্ষম হবেন ‘জনগণের সেবক’ পুলিশকে।

সূত্র:দৈনিক কালের আলো ডটকম।





০ মন্তব্য

আরও পোস্ট পড়ুন

মতামত দিন