আওয়ামী লীগকে কেউ নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না বলে জানিয়েছেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা বারবার হয়েছে। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে বারবার সেই চেষ্টা হলেও কেউ সফল হয়নি। জাতির পিতার হাতে যে দল গড়ে উঠেছে, যে দল তার আদর্শের ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে চলছে সেই দলকে কেউ নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না।

শুক্রবার বিকালে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের ২১তম সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

আওয়ামী লীগের সংগ্রামী অতীতের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের ওপর আঘাত এসেছে বারবার। জাতির পিতাকেও কতবার হত্যাচেষ্টা হয়েছে। তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। ফাঁসিতে ঝুঁলানোর ষড়যন্ত্র হয়েছে। তবে সফল হয়নি। আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণভাবে শেষ করে দেয়ার অনেক চেষ্টা অনেকবার হয়েছে। ইয়াহিয়া, আইয়ুব থেকে শুরু করে জিয়া, এরশাদ, খালেদা সবাই প্রথম আঘাত করেছে আওয়ামী লীগকে। তবে আদর্শ সংগঠন বলেই কেউ আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সংগঠনকে কেউ ধ্বংস করতে পারেনি।’

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকেই এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে গঠন করা কোনো দল নয়। বরং একেবারে গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করার লক্ষ্য নিয়ে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠিত। যে কারণে বাংলার মানুষের যতটুকু অর্জন, তা যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, আমরা দেখবো একমাত্র আওয়ামী লীগ যখন সরকারে এসেছে, কাজ করেছে তখনই মানুষ কিছু পেয়েছে। শুধু আওয়ামী লীগই এদেশের মানুষকে কিছু দিতে পেরেছে।’

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর উদ্ধৃতি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের জন্য এটা একান্তভাবে দরকার। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘নীতিবিহীন নেতা নিয়ে অগ্রসর হলে, সেটা সাময়িকভাবে কিছু ফল পাওয়া যায় কিন্তু সংগ্রামের জন্য তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না।’ এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বাস্তবতা। যেকোনো রাজনৈতিক নেতার জীবনে নীতি আদর্শ সবচেয়ে বড় কথা। আর আদর্শের জন্য ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত থাকার কথা। যিনি প্রস্তুত থাকতে পারেন, ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন তিনিই সফল হতে পারেন। দেশকে ও জাতিকে কিছু দিতে পারেন। আওয়ামী লীগ সেই সংগঠন যার নেতাকর্মীরা বারবার আত্মত্যাগ করেছে এবং তারই ফসল বাংলাদেশের জনগণ আজ পেয়েছে। আজকের বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নত-সমৃদ্ধির পথে।’

‘আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেব চিন্তাও করিনি’

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘১৯৮১ সালে দল আমাকে আমার অনুপস্থিতিতে সভাপতি নির্বাচিত করে। রাজনীতি আমার জন্য নতুন কিছু ছিল না। স্কুলজীবন থেকে মিছিলে অংশগ্রহণ করতাম, দেয়াল টপকে চলে যেতাম ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিতে। কলেজজীবনে সরাসরি রাজনীতি করেছি। কলেজে কলেজে ঘুরে সংগঠন করেছি। কলেজে ভিপি নির্বাচিত হয়েছি। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি। তবে চিন্তাও করিনি আওয়ামী লীগের মতো দলের নেতৃত্ব বা দায়িত্ব নিতে হবে বা এত বড় গুরু দায়িত্ব আমি নিতে পারবো।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পঁচাত্তরে বাবা, মা ভাই সবই হারিয়ে ছিলাম। ছয়টি বছর রিফিউজি হিসেবে কাটিয়েছিলাম। নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর ছয়টি বছর দেশে আসতে পারিনি। রেহানার পাসপোর্টটিও পর্যন্ত রিনিউ করতে পারেনি। জিয়া আমাদের দেশে আসতে দেয়নি। আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত করেছিল বলেই জনগণের সাড়া মিলে। দলের নেতাকর্মীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে একরকম জোর করেই দেশে ফিরেছিলাম।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতাকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করা হয়। বিচারের পথ বন্ধ করা হয়। খুনিদের পুরস্কৃত করা হয়। খুনিদের দল করার সুযোগ দেয়া হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে তাদের মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত করা হয়। সেই বৈরী পরিবেশে ফিরে এসে দলের হাল ধরেছি।’

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করার চেষ্টা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নানা ব্রাকেট এই ধরনের অবস্থা ছিল। চেষ্টা করেছি সাধ্যমতো, এই আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার জন্য। তারপরও আঘাত এসেছিল। আমাদের নিজেদের মধ্যে ভাঙন হয়েছে একবার-দুবার। সেই ভাঙন আবার আমি নতুনভাবে গড়ে তুলেছি। দলকে সংগঠিত করতে সারাদেশে ঘুরেছি। এই সংগঠনকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছি। আজ আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী সংগঠন।’

বিগত এক দশকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে থাকলেও সেই পথ সহজ ছিল না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও সন্ত্রাস করে, না থাকলেও সন্ত্রাস করে। তাদের অগ্নিসন্ত্রাসের কারণে ৫০০ লোক মারা গেছে। এখনো ভুক্তভোগী হাজার হাজার মানুষ। আমরা একদিকে বিএনপির সন্ত্রাসী কার্যকলাপ মোকাবিলা করেছি। অপরদিকে দেশের মানুষ যাতে নিরাপদে, শান্তিতে এবং অর্থনৈতিক উন্নতি করতে পারে সেই জন্য ব্যাপক কর্মযজ্ঞ নিয়েছি।’

বাকি জেলায় দ্রুত সম্মেলন শেষ করার তাগিদ

সম্মেলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমাদের ২৯টি সাংগঠনিক জেলার সম্মেলন হয়ে গেছে, বাকিগুলোও দেয়া হয়েছিল, কিন্তু ডিসেম্বর অত্যন্ত ব্যস্ততার দেখে আমরা করতে পারিনি। আমাদের জাতীয় সম্মেলনের পরে বাকি সমস্ত জেলার কাউন্সিল আমরা করবো, একেবারে তৃণমূল থেকে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলার সম্মেলন হবে। প্রতিটি এলাকার কমিটির নামের ডাটাবেজ থাকবে। এই সংগঠনকে তৃণমূল পর্যন্ত শক্তিশালী করা আমাদের লক্ষ্য।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্বাচিত তাদের অভিনন্দন, যারা পারেন নাই, তারা খুব দ্রুতই করে ফেলবেন। সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠনক চাঙ্গা হয়, শক্তিশালী হয় কাজে আমরা সেভাবে এই সংগঠনকে করে দিতে চাচ্ছি।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বর্ণিল আয়োজন

সম্মেলনে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, অভ্যর্থনা উপ-কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ নাসিম।

বিকাল তিনটায় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় দুই দিনের সম্মেলন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হবে কাউন্সিল অধিবেশন। সেখানে ঐতিহ্যবাহী দলটির আগামী তিন বছর কারা নেতৃত্ব দেবে তা বাছাই করা হবে।

এদিকে সম্মেলন উপলক্ষে শুক্রবার সকাল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেতাকর্মীদের জন্য জুমার নামাজের ব্যবস্থা করা হয়। বেলা তিনটার দিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসেন। তিনি এসে জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা, দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরে শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে সম্মেলনের শুভ উদ্বোধন করেন তিনি।

উদ্বোধনের পরে সম্মেলনের সংস্কৃতিক উপ-কমিটির উদ্যোগে এক মনোজ্ঞ সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৫ আগস্টের কালরাতের ঘটনা এবং বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশের এগিয়ে চলার চিত্র ফুটে ওঠে।





০ মন্তব্য

আরও পোস্ট পড়ুন

মতামত দিন