ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, বিপিএম (বার)। বাংলাদেশ পুলিশের ২৯ তম ইন্সপেক্টর জেনারেল। বাংলাদেশ পুলিশ পরিবারের সদস্য হিসেবে সুদীর্ঘ ৩৫ বছরের পথ-পরিক্রমা শেষে আজ বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস থেকে অবসর গ্রহণ করছেন। আইজিপি থাকাকালীন তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান এই বিদায়ল‌গ্নে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করছে বাংলাদেশ পুলিশ।

স্যার,
কেবল বাংলাদেশ পুলিশের প্রধান হিসেবে নয়, সমগ্র কর্মজীবনেই আপনি বাংলাদেশ পুলিশকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট ছিলেন। আধুনিক, প্রযুক্তিজ্ঞান সমৃদ্ধ, সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম মননে-মানসে মানবিক পুলিশ প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রয়াস গ্রহণ করেছেন। সর্বোপরি বাংলাদেশ পুলিশকে ‘জনতার পুলিশ’ হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল আপনার একান্ত প্রচেষ্টা।

বাংলাদেশ পুলিশের সদস্য ও তাদের পরিবারের সার্বিক কল্যাণে আপনি বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। আইজিপি হিসেবে আপনার কর্মকালে সদস্যদের কল্যাণে রেশন, চিকিৎসা সুবিধা ও বিভিন্ন ভাতার আমূল সংস্কার করা হয়েছে। কর্তব্যরত অবস্থায় নিহত পুলিশ সদস্য ও তা‌দের পরিবারের জন্য রেশন সুবিধা ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের আজীবন রেশন সুবিধা চালু করতে আপনি কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছেন। পুলিশের আবাসন সমস্যা সমাধানের জন্য পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের অবকাঠামো নির্মাণকাজ জোরেশোরেই চলছে। আপনি পুলিশ সদস্যদের মেধাবী সন্তানদের জন্য মেধাবৃত্তি প্রবর্তন করেছেন। আপনার হাত ধরেই বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের নিজস্ব ব্যাংক কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এ ছাড়াও, ১৩টি জেলা শহরে পুলিশ হাসপাতাল নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে।

জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমন এবং মাদকদ্রব্যের বিস্তার রোধে আপনি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। উভয় ক্ষেত্রেই আপনি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছেন। জঙ্গি-সন্ত্রাস দমন ও মাদক নিয়ন্ত্রণসহ প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুলিশের দৃশ্যমান সাফল্যে জনমনে আজ আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি হয়েছে।

আপনার সময়কালে পুলিশের নিয়োগ,পদোন্নতি এবং পদায়নসহ সার্বিক কার্যক্রমেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ পুলিশে ৩৫০০জন সাব-ইন্সপেক্টর এবং ১০০০০ কনস্টবল নিয়োগ অত্যন্ত স্বচ্ছতার সাথে সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশে ২১৫টি পুলিশ সুপারের পদ সৃজন করা হয়েছে এবং ২৩০ জন কর্মকর্তাকে পুলিশ সুপার পদে সুপার নিউমারারি পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও শূন্য পদসমূহের বিপরীতে যথাসময়ে পদোন্নতি নিশ্চিত করা হয়েছে।

বর্তমান সরকার আইন-শৃঙ্খলা খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ পুলিশ আজ হয়ে উঠেছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় পূর্বের যেকোন সময়ের তুলনায় অধিকতর দক্ষ ও যোগ্য। পুলিশে বিশেষায়িত নতুন নতুন ইউনিট গঠনসহ জনবল বৃদ্ধি এবং আধুনিক সরঞ্জামাদি, যানবাহন ও লজিস্টিক পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আপনার সময়কালে গাজীপুর ও রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ, এয়ারপোর্ট এপিবিএন ও কক্সবাজারে দুইটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও একটি র‌্যাব ব্যাটালিয়ন এবং সাইবার পুলিশ ইউনিটসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত ইউনিট গঠন করা হয়েছে।

আপনার বিশেষ উদ্যোগে পুলিশের সেবা জনগণের কাছে সহজে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে জনসাধনের অতিপ্রিয় ও পরিচিত ‘জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯’ কে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স এবং ফায়ার সার্ভিসের মতো জরুরি সেবা পেতে মানুষ ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছে। পথচলা শুরুর পর থেকে প্রায় দুই কোটি কল গ্রহণ করা হয়েছে এবং ৫৮ লাখ সেবা প্রদান করা হয়েছে। এমনকি করোনা ভাইরাস সংক্রমিত ব্যক্তির চিকিৎসাসহ অন্যান্য সহযোগিতা প্রাপ্তির লক্ষ্যেও জনসাধারণ ৯৯৯ এর শরণাপন্ন হচ্ছে।

সার্বিক আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আপনি নিয়েছেন কার্যকর উদ্যোগ। একাদশ জাতীয় নির্বাচন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন, জেলা পরিষদ নির্বাচন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন উপ-নির্বাচনে বাংলাদেশ পুলিশ পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছে। এছাড়াও আপনার নেতৃত্বে সাইবার অপরাধ দমন, চরমপন্থী- জলদস্যু ও বনদস্যুদের আত্মসমর্পন, সাইবার অপরাধ, বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনে বাংলাদেশ পুলিশ দৃশ্যমান সাফল্য অর্জন করেছে।

দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমন সনাক্তের পরপরই আপনার নির্দেশনায় এ ভাইরাস প্রতিরোধে জনগণকে সচেতন করা, সরকারি নির্দেশনা ও জরুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে সচেতনতামূলক কার্যক্রম, লিফলেট বিতরণ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার ও বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে বাংলাদেশ পুলিশ। লোকাল ক্যাবল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা, মসজিদ, মন্দির, পাড়া-মহল্লা, হাট-বাজারে জনগণকে সচেতন করার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

আপনার পরামর্শে সর্বপ্রথম ইমিগ্রেশন পুলিশ কর্তৃক জনসাধারণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের লিফলেট ও সনাক্তকরণ সিল প্রদান করেছে। বিদেশ হতে আগত ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তুত করে জেলা পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন, জেলা প্রশাসক ও জেলা আনসার এ্যাডজুটেন্টগণের নিকট প্রেরণ করা হয়। এ ছাড়াও বিদেশ হতে আগত ব্যক্তিদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা প্রদান/উৎসাহিতকরণ/সচেতনতামূলক কার্যক্রম(মাইকিং/লাল পতাকা টানানো/ স্টিকার) গ্রহণ করা হয়। দেশি-বিদেশী নাগরিকগণের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

করোনাকালে আপনার নির্দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং মজুদদার ও কালোবাজারি রোধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সকল ধরণের সমাবেশ, গণজমায়েত এবং সোশ্যাল ডিসট্যান্স ও চলাচল সীমিতকরণ/রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত আছে।

পুলিশ সারাদেশে কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানুষকে সহায়তা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যগণ স্বতস্ফুর্তভাবে মানবিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষের খাবার, ওষুধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে। সারাদেশে পুলিশ দুস্থ ও অসহায় মানুষের মাঝে যথাসাধ্য ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করছে। বিভিন্ন পুলিশ ইউনিট কর্তৃক ভাইরাসটির বিস্তার রোধে বিভিন্ন এলাকায় জীবাণুনাশক স্প্রে করছে। হাইওয়েতে পণ্য পরিবাহী যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখার জন্য এবং সারাদেশে গণপরিবহন বন্ধ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের সকল অপারেশনাল ইউনিট সার্বক্ষণিক বাজার ব্যবস্থাপনা ও পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা তদারকি করছে।
আপনার নির্দেশে সকল ইউনিটে পুলিশ সদস্যদের করণীয়/বর্জনীয় সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে এবং এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হচ্ছে। নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রান্তে বাংলাদেশ পুলিশের নির্দেশিকা প্রণয়ন করে প্রেরণ করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণকরতঃ প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের, অফিস, ব্যরাক, থানা ও ফাঁড়ি স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে এ সংক্রান্তে মনিটরিং এন্ড কো-অর্ডিনেশন সেল গঠন করা হয়েছে।

সকল দুঃসময় এবং দুর্যোগে পুলিশ সদস্যরা অকুণ্ঠ চিত্তে দেশ ও জনগণের সেবায় আত্মনিবেদিত। একাত্তরের রণাঙ্গনে পুলিশ সদস্যদের হাত ছিল প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের হাত। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে ধারণ করে সময়ের প্রয়োজনে সেই হাত হয়ে ওঠে সেবা ও মানবতার, আস্থা ও নির্ভরতার। বিশ্বব্যাপী নভেল করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশেও বিস্তার লাভ করেছে। এ সংকটময় মুহূর্তে নভেল করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে সকল ভীতি আর শঙ্কার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের সেবায় নিরলসভাবে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করতে অগ্রসেনানী হিসেবে রাস্তায় নেমেছে পুলিশ।

মধ্যবিত্তের মাঝে খাবার/সাহায্য পৌঁছে দিচ্ছে পুলিশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে পুলিশ সদস্যদের বেতনের ২০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে পুলিশ। নিজেদের বেতন ও রেশন হতে সামগ্রী বিতরণ করছে পুলিশ। পাসপোর্টের ঠিকানায় অবস্থান না করা প্রবাসীদের ঘরে ঘরে গিয়ে খুঁজে বের করছে পুলিশ। অসহায় মানুষকে খাদ্য সাহায্য দিচ্ছে পুলিশ। ত্রাণ আত্মসাৎকারীদের আইনের আওতায় আনছে পুলিশ। জনসাধারণকে গান গেয়ে ঘরে থাকতে উৎসাহ দিচ্ছে পুলিশ। করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত আক্রান্তদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসাকর্মীদের কর্মস্থলে পৌঁছে দিচ্ছে পুলিশ। জানাজা পড়ছে পুলিশ, কবর খুঁড়ছে পুলিশ, দাফন করছে পুলিশ। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে এ অনবদ্য ভূমিকার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুলিশ সদস্যদেরকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

করোনার কারণে সৃষ্ট এ মহাসংকটে মানবিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পুলিশ সদস্যদের এমন দায়িত্ব পালন আপনার দেখানো ‘মানবিক পুলিশ’ এর যেন বাস্তব রূপ। “মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার”- এ স্লোগানকে ধারণ করে বাংলাদেশ পুলিশকে ‘জনতার পুলিশ’ হিসেবে গড়ে তুলতে আপনার রয়েছে অসামান্য অবদান।

বাংলা‌দেশ পু‌লি‌শের হ‌য়ে প্রিয় মাতৃভূ‌মি‌কে দীর্ঘ পয়‌ত্রিশ বছর যে সেবা আপ‌নি দি‌য়ে‌ছেন তার জন্য বাংলা‌দেশ পু‌লিশ গ‌র্বিত। বাংলা‌দেশ পু‌লি‌শের প্র‌ত্যেক সদস্য অকুন্ঠ‌ চি‌ত্তে আপনা‌কে স্মরণ কর‌বে।

ধন্যবাদ স্যার!





০ মন্তব্য

আরও পোস্ট পড়ুন

মতামত দিন