মানবিক মর্যাদা বৃদ্ধি ও জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে স্পষ্টতই আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। উন্নয়নের রোডম্যাপ অনুসরণের পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার রক্ষায় সৃষ্টি করল নতুন এক ইতিহাস।
ইতিহাসের অংশ হিসেবে আজ শনিবার ভূমিহীন গৃহহীন ৬৬ হাজার ১৮৯ পরিবারকে ঘর উপহার দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের ৪৯২ উপজেলার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঘরের চাবি, কবুলিয়ত দলিল হস্তান্তর কাজের উদ্বোধন করবেন তিনি। দেশজুড়ে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা সহায় সম্বলহীন মানুষ প্রাথমিকভাবে বুঝে পাওয়া নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে আজকের এই মাহেন্দ্রক্ষণটির জন্য।
উন্নত দেশগুলোতে ‘সোশ্যাল সেইফটি’ ইস্যুতে উলে−খযোগ্য অনেক কাজ হলেও, একসঙ্গে বিপুল জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে মাথাগোঁজার ঠাঁই করে দেয়ার ঘটনা বিশ্বে এটিই প্রথম বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করছে বাংলাদেশ। উদ্যাপনের অংশ হিসেবে সরকারী ও বেসরকারীভাবে অজুত উৎসব অনুষ্ঠান আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেছে। বাকিগুলো এখনও স্থগিত। তবে এ অবস্থার মধ্যেও গৃহহীনদের বিনামূল্যে ঘর প্রদানের বিপুল কর্মযজ্ঞ চলমান ছিল। মুজিববর্ষের সব কর্মসূচীর মধ্যে এটি আলাদা বৈশিষ্ট্যের।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করা মানুষ এর দ্বারা সরাসরি উপকৃত হবে। অত্যন্ত সুচিন্তিত কর্মসূচীর আওতায় দেশে মোট ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২ পরিবারের বাসস্থানের অধিকার নিশ্চিত করা হবে বলে জানা যায়। যখন বৈশ্বিক অর্থনীতি বিরাট চাপের মুখে পড়েছে, শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকা রাষ্ট্রগুলো যখন দুশ্চিন্তায়, সর্বোপরি অন্য দেশ থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যখন গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে বাংলাদেশের গলায় তখন নতুন করে বিপুলসংখ্যক মানুষকে ঘর করে দিয়ে রীতিমতো চমকে দিল শেখ হাসিনা সরকার। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যেন তার ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’ নীতিকেই সত্য প্রমাণ করল বহুবার।
মুখ্য সচিব আহমদে কায়কাউস গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান, ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বিরাট এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দুই কক্ষ বিশিষ্ট ঘর দেয়ার পাশাপাশি প্রতিটি পরিবারকে ২ শতাংশ খাস জমির মালিকানা প্রদান করা হবে। পাশাপাশি এই পরিবারগুলোর কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করবে সরকার। তিনি জানান, তিনটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ৪১৯ কোটি ৬০ লাখ টাকায় ২৪ হাজার ৫৩৮টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ সহনশীল ঘর নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে ৩৮ হাজার ৫৮৬টি ঘর। এ জন্য খরচ হয়েছে ৬৫৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। ভূমি মন্ত্রণালয়ের গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের আওতায় ৫২ কোটি ৪১ লাখ টাকায় নির্মিত হয়েছে ৩ হাজার ৬৫টি ঘর। প্রকল্পগুলোতে মোট ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১৬৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। একই সঙ্গে এত পরিবারের পুনর্বাসনের নজির পৃথিবীতে আর নেই জানিয়ে আহমেদ কায়কাউস বলেন, এখন যেভাবে পুনর্বাসনের কাজ চলছে, তাতে আগামী ২ বছরের মধ্যে গৃহহীন পৌনে ৯ লাখ পরিবারের প্রত্যেকটি ঘর পাবে বলে আশা করা যায়।
একই দিন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব মোঃ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া জানিয়েছেন, জমি ও ঘরের বাজারমূল্য হিসাব করলে একেক পরিবার প্রায় ১০ লাখ টাকার সম্পদ পাচ্ছে। মালিকানার ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী দুজনের নামেই জমি নিবন্ধন করা হয়েছে। নিবন্ধনের দলিলে থাকছে স্বামী-স্ত্রী দুজনের নামই। এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের আগে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন। মৌলভীবাজারে ১১২৬, সাতক্ষীরা জেলায় ১১৪৮ টি, ব্রা্হ্মণবাড়িয়ায় ১০৯১, কিশোরগঞ্জে ৬১৬, নোয়াখালীতে ৮৫৫, রাজশাহীতে ৬৯২, মাগুরায় ১১৫টিসহ দেশের আনাচে কানাচে আজ ঘর প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা চলবে।
গত বুধবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মোড়াপারা, বৃহস্পতিবার কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর ও শুক্রবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাওড়ায় অবস্থিত উলে−খযোগ্য কয়েকটি আশ্রয়ণ প্রকল্প সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সদ্যনির্মিত সেমি পাকা বাড়িগুলো ঘিরে এখন উৎসবের আমেজ। মোড়াপারায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেষে গড়ে তোলা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ২০টি আধাপাকা ঘর।
প্রতিটি ঘরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বসানো হয়েছে দুটি আর্সেনিক মুক্ত বিশুদ্ধ খাবার পানির ট্যাঙ্ক। এখানে স্থায়ীভাবে আশ্রয় পাওয়া অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তি করে চলেন। তবে এখন তাদের চোখে মুখে নতুন করে শুরু করার স্বপ্ন। তাকিয়ে আছেন আজকের দিনটির পানে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার দিঘীরপাড়ে অনরূপ ২৫টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
সুবিধাভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশির ভাগ মানুষই নদী ভাঙনের শিকার। তারাও অতীত ভুলে ‘মজিবরের’ কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া ঘরে বসবাস শুরু করতে চান। একইভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাওড়ায় প্রস্তুত রয়েছে ৪৫টি নতুন বাড়ি। সংশি−ষ্টদের সঙ্গে কথা জানা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের কোন বাড়িটি কার হবে তা নির্ধারণ করা হয়েছে লটারির মাধ্যমে। প্রত্যেকে নিজ নিজ বাসা প্রাথমিকভাবে বুঝেও পেয়েছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে আজ বাড়ির চাবি, কবুলিয়ত দলিল, নামজারি, ডিসিআর কপি বুঝিয়ে দেয়া হবে। সে জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন তারা। সরেজমিন ঘুরে গৃহহারা এসব মানুষের সঙ্গে কথা বলে অনুমান করা যায়, রাষ্ট্র বা কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা তাদের ভেতরে আজও জন্মায়নি। নিজের দায় থেকে রাষ্ট্র পৌঁছে গেছে তাদের কাছে। সরকার উদ্যোগী হয়ে খুঁজে নিয়েছে তাদের। মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে তাদের ঘর করে দিয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সর্বনিম্নস্তরে যাদের অবস্থান তারা এসব ‘দালানকোঠার’ মালিক হচ্ছেন। একে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, ‘এমপাওয়ারমেন্ট।’ দয়া বা দান নয়, উপহার হিসেবে আজ ঘরগুলো প্রদান করবেন প্রধানমন্ত্রী। ‘উপহার’ শব্দটি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি গৃহহীনদের ঘর দেয়ার পাশাপাশি মর্যাদার একটি আসনও দেয়ার চেষ্টা করছেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে। আজকের দিনটিকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারাও। এ প্রসঙ্গে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, বিভিন্ন অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকে সঙ্গে দিন রাত কাজ করেছি আমরা। জেলায় মোট ৬১৬টি গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে। একেবারেই নিঃস্ব মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে তাদের তালিকা করে ঢাকায় পাঠিয়ে ছিলাম আমরা। আজ তারা ঘর বুঝে পাবেন। এমন একটি কাজের সঙ্গে থাকতে তার বিশেষ ভাল লাগছে বলে জানান তিনি।
একই প্রসঙ্গে বাজিতপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপ্তিময়ী জামান বলেন, আমরা ভূমিহীন গৃহহীন প্রায় প্রতিটি মানুষের কাছে সশরীরে পৌঁছার চেষ্টা করেছি। নানাভাবে তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গৃহনির্মাণের প্রতিটি পর্বে উপস্থিত থেকেছেন উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। আজ প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সেই শ্রম স্বার্থক হবে বলে মনে করেন তিনি। গৃহীত প্রকল্পগুলোর অন্যতম একটি আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প।
প্রকল্পের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোঃ মাহবুব হোসেন এ কাজের তদারকি করছেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, দেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ঘোষণা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা। কাজের সুবিধার্থে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দেশের সব ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। ঘর এবং জমি নেই এমন পরিবারের সংখ্যা দুই লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১। জমি আছে, ঘর নেই এমন পরিবারের সংখ্যা পাঁচ লাখ ৯২ হাজার ২৬১টি। সর্বমোট আট লাখ ৮৫ হাজার ৬২২ পরিবারকে পর্যায়ক্রমে বাসস্থান নির্মাণ করে দেয়া হবে বলে জানান তিনি।