পদ্মাপাড়ের ট্রাজেডি:!
চাকুরী জীবনে সাধারণত পুলিশি দায়িত্বের বাহিরে চলাফেরার ক্ষেত্রে পুলিশি পরিচয় কোথাও প্রকাশ করে চলিনি। বাস্তব জীবনে জীবনমান কেমন কিংবা যখন পুলিশ ছিলাম না অথবা যখন পুলিশ থাকবো না তখনকার কথা ভেবেই এমন চিন্তা ভাবনা। যার ফলে চলার পথে অনেক দুর্মূল্য অভিজ্ঞতা ও সঞ্চয় হয়ে থাকে।
স্পীডবোট দুর্ঘটনায় ২৬ টি তাজা প্রাণ নিঃশেষ হয়ে গেল। এর দায় কার, এনিয়ে হয়তো পক্ষ-বিপক্ষ অনেক বিজ্ঞজনের মতামত থাকবে। চাকুরী জীবনের শুরুতে প্রবেশনার হিসেবে শরীয়তপুর জেলায় কর্মরত থাকাকালীন মাওয়া থেকে জাজিরা, মাঝিরঘাট এসব এলাকায় স্পিডবোটে যাতায়াত করেছি। ছাত্র জীবন শেষ করে চাকুরী জীবনে প্রবেশের প্রথম ধাক্কায় হয়তো অন্যরকম একটি ভাবনা থাকে। সেসময় পদ্মা নদীতে এই স্পিড বোর্ড গুলোর অরাজকতা নিজের চোখে দেখেছি। কয়েকবার দুপারের পুলিশকে দিয়ে চেষ্টাও করা হয়েছিল তাদেরকে নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু চরম দুর্বৃত্তদের হাতে এই বোট ব্যবসা থাকার কারণে অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও অসহায় হতে দেখেছি। ডাকাত দস্যু দের আচরণ আরো অনেক ভালো হয়ে থাকে সেখানকার বেশিরভাগ স্পিডবোটের চালক, হেল্পার ,মালিক এবং সমিতির সদস্যদের থেকে। আমি নিজে একবার চরম ধৈর্য্য হারা হয়ে তাদেরকে দু-একটি ভালো কথা বলতে গিয়ে এই নিম্নশ্রেণির লোকদের যে আচরণ স্বচক্ষে অবলোকন করেছি তা কল্পনাও করা যায় না। ঘটনার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে নিজেকে শান্ত করে সেদিন পদ্মা পার হয়েছিলাম। এমনকি নামার সময় দূর থেকে আমাকে লক্ষ্য করে অশ্লীল শব্দ করতে শুনেছি। লোকাল পুলিশের সাথে এবিষয়ে আলোচনা করে জেনেছি বেশ কয়েকবার স্বয়ং পুলিশ এদের হাতে নাজেহাল হয়েছে।
ব্যক্তি জীবনের একটি অভিজ্ঞতা এই সমস্ত নদী পারাপারের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ সম্পর্কে নিজে আগেই কিছুটা অবগত ছিলাম। দাউদকান্দি ব্রিজ উদ্বোধন হবার অল্প কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে যাবার পথে ফেরিতে এক গ্লাস পানি কিনে খেয়েছিলাম। তখন ফেরিতে ,স্টেডিয়ামে, বাসস্টপে কলসিতে করে গ্লাসে পানি বিক্রি হতো। ফেরিতে পার হওয়ার সময় ১২/১৩ বছর বয়সী একটি মেয়ে তেমনি কলসিতে করে পানি বিক্রি করছিলেন। আমি বাস থেকে নেমে বাসের পাশে দাঁড়িয়ে তার থেকে এক গ্লাস পানি নিলাম। পানি সম্ভবত প্রতি ক্লাস এক টাকার মত ছিল। ৫০ টাকার নোট তাকে দিলাম আমার কাছে খুচরা না থাকার কারণে। টাকা দেওয়ার পর মেয়েটি বাকি টাকা ফেরত না দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। আমি তাকে ডেকে বাকি টাকা ফেরত চাইতেই সে বলল আপনি তো কোন টাকা দেননি আমাকে। মেয়েটির তাৎক্ষণিক আচরণে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এভাবে এককথায় দু কোথায় আরো কয়েকজন হকার টাউট জমা হল। তখন বাসের ড্রাইভার হেলপার এসে আমাকে গাড়িতে তুলে নিল। তারা আমাদেরই এলাকা মানুষ ছিলেন তাই হয়তো বিপদ বুঝতে পেরে এ কাজ করলো। পরে গাড়িতে উঠার পর ড্রাইভার আমাকে বলল তুমি ছাত্র মানুষ এরা সঙ্ঘবদ্ধ, মানুষের সাথে এরকম করে উল্টো মানুষকে নাজেহাল করে, টাকার কথা ভুলে যাও। বিভিন্ন সময়ে এই সমস্ত জায়গায় মানুষের নাজেহাল হওয়ার কথা বিভিন্নভাবে জানতাম। তাই এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না করে ৫০ টাকা লস করে বাসায় ফিরলাম।
মেঘনা আর দাউদকান্দির সে সমস্ত দালাল টাউট হকারদের ব্যবসা আজ আর নেই। যদিও পরবর্তীতে উক্ত এলাকায় চার লেনের রাস্তা হওয়ায় এক পাশ থেকে নির্মাণাধীন সড়ক হয়ে যাওয়ার পথে গ্রিন লাইন পরিবহনের একটি বাসে ভয়ানকভাবে ডাকাতের দল হামলা করে। সেদিন উক্ত বাসে পরিবারের সদস্যগণ সহ ছিলাম। রাত ৩ ঘটিকার সময় কুমিল্লা জেলা পুলিশের সহযোগিতায় সকল যাত্রীগণ সহ ডাকাতদের কবলে থেকে নিরাপদে গমন করেছিলাম। তা নিয়ে অন্য এক সময় লিখব কতিপয় যাত্রীর অকৃতজ্ঞতা অবলোকন।
২০০৬ সালে মাওয়া থেকে মাঝিরঘাট একশত বিশ টাকা সম্ভবত ভাড়া ছিল প্রতি ব্যক্তি। ১০ জনের স্থলে ১২/১৪ জন নিত। মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে কিছু ছিল না, সম্ভবত এখনও নেই। আমার মনে হয় বিভিন্ন ফেরিঘাট স্পিড বোট সার্ভিস এর ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষের কমবেশি এমন খারাপ অভিজ্ঞতা আছে।
সেরকম অতিলোভী ডাকাত-দস্যুদের লোভের এবং চরম দস্যুতার শিকার হয়ে ২৬ জন মানুষের মূল্যবান প্রাণ চলে গেল। তারা হয়তো ভাবছে এইতো আর কয়দিন পরেই পদ্মা সেতু চালু হয়ে যাবে, তখন আর তাদের এমন ডাকাতি করার সুযোগ থাকবে না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কে অসংখ্য ধন্যবাদ শুধু একটি সেতু নির্মাণ করে মানুষের যাতায়াতের গতিকে ত্বরান্বিত করবেন না বরং অসংখ্য মানুষের হয়রানি, নাজেহাল, অপদস্ত এমনকি সলিল সমাধি হওয়ার হাত থেকে আমাদেরকে রক্ষা করতে চলেছেন। নিগৃহীত, নিষ্পেষিত মানুষের অন্তর থেকে অসংখ্য দোয়া থাকবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি।
সময়ের থেকে জীবনের মূল্য অনেক বেশি, একথাটি আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে। জীবন একটাই, জীবনকে ভালোবাসুন।
“মূর্খদের সঙ্গে কখনো তর্ক করতে যাবে না কারণ মূর্খরা তোমাকে তাদের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে এসে তর্কে হারিয়ে দিবে”
লেখক:মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান পিপিএম-বার,পুলিশ সুপার,সাতক্ষীরা।