একেকজন ছিলেন ভয়ঙ্কর জলদস্যু। ফিশিং বোটে বঙ্গোপসাগরের জেলেদের ওপর তান্ডব চালাতো। হতাহতের ঘটনাও ছিল নৈমিত্তিক বিষয়। কিন্তু অন্ধকার জীবন থেকে তাঁরা ফিরে এসেছে আলোকিত জীবনে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল স্বাভাবিক জীবনে ফেরায় তাদের ফুল দিয়ে বরণ করেছেন। প্রত্যেকের হাতে তুলে দিয়েছেন নগদ ৫০ হাজার টাকা।

সুপথে ফেরা তাদের স্বাগত জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, বিপিএম (বার) নিজেও। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন পুরো কক্সবাজার জেলায় কোন দস্যুতা চলবে না। সতর্ক করেছেন স্বাভাবিক জীবনে না ফিরলে কঠিন পরিণতির।

শনিবার (২৩ নভেম্বর) সকাল ১১টায় মহেশখালী উপজেলার পাহাড়ি ইউনিয়ন কালারমারছড়া ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী’র কাছে আত্মসমর্পণ করেন এ জলদস্যুরা।

কক্সবাজারের মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া ও কুতুবদিয়ার ১২ বাহিনীর দুর্ধর্ষ ৯৬ জলদস্যু, অস্ত্রের কারিগর ও সন্ত্রাসী স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি ছিল ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’। ভয়ঙ্কর এ জলদস্যুরা দেশি-বিদেশি ১৫৫টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২৮৪ রাউন্ড গুলি ও অস্ত্র তৈরির বিভিন্ন প্রকার সরঞ্জামও জমা দেন।

এর আগে ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর মহেশখালীতে ৪৩ সশস্ত্র জলদস্যু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।

এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, আত্মসমর্পণকারীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তবে আগের কাজে ফিরে গেলে তাদের কঠোর পরিণতি হবে। তিনি বলেন, খুন ও ধর্ষণ ছাড়া যাদের বিরুদ্ধে লঘু অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা হবে।

বিভিন্নভাবে যারা বিপথে চলে গেছে, তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে তারা সবাই ফিরে আসবে, স্বাভাবিক জীবনযাপন করে শান্তিপূর্ণ দেশ বিনির্মাণে সহযোগিতা করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন মন্ত্রী।

অনুষ্ঠানের গেস্ট অব অনার পুলিশের আইজি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, যেসব জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেননি তারা ভুল করেছেন। মহেশখালী এমনকি পুরো কক্সবাজার জেলায় কোনো দস্যুতা চলবে না। এখনও যারা বিপথগামী, তারাও ফিরে আসুন। স্বাভাবিক জীবনে না ফিরলে কঠিন পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকুন। তিনি সাংবাদিকদের পেশাদারিত্বের প্রশংসা করেন।

পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে কোন জঙ্গি, সন্ত্রাসী, অপরাধীর স্থান হবেনা। যে কোন সময় ৯৯৯ নাম্বারে কল করে পুলিশের অনিয়মের বিরুদ্ধেও বলতে পারবেন। সে যেই হোক অপরাধীর ছাড় নেই।’

কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের সভাপতিত্বে পুলিশ লাইন্স মসজিদের পেশ ইমাম এএসআই আবদুল মন্নানের কোরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন মহেশখালী-কুতুবদিয়ার সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক, কক্সবাজার-১-এর সাংসদ জাফর আলম, কক্সবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাইমুন সরওয়ার কমল,

চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক, কক্সবাজার জেলা ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক আশরাফুল আফসার, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তাফা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র মুজিবুর রহমান প্রমুখ।

আত্মসমর্পণকারী ১২ দস্যুবাহিনীর মধ্যে জলদস্যু ও অস্ত্রের কারিগর আয়ুব বাহিনীর প্রধান আয়ুবসহ ১২ জন, আবদুল করিম বদিয়া বাহিনীর প্রধান আবদুল করিম বদিয়া, গুরা কালু বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ কালু, হামিদ বাহিনীর প্রধান মো. আবদুল হামিদ, কালা জাহাঙ্গীর বাহিনীর প্রধান মো. কালা জাহাঙ্গীর, জিয়া বাহিনীর প্রধান জিয়াউর রহমান, করিম বাহিনীর প্রধান মাহমুদুল করিম, সিরাজ বাহিনীর প্রধান সিরাজ দৌল্লাহ চৌধুরী, স্বপন বাহিনীর প্রধান মান্নান দে স্বপন, মিন্টু বাহিনীর প্রধান আবদুল্লাহ মিন্টু, সিকদার বাহিনীর ২ জন, সোনাদিয়ার আঞ্জু বাহিনীর ১ জন, জুনায়েত বাহিনীর ২ জন, কালা জাহাঙ্গীর বাহিনীর ১ জন, অস্ত্রের কারিগর ৯ জন, কলাবাদা বাহিনীর ২ জন, স্বপন বাহিনীর ১ জন, জিয়া বাহিনীর ২ জন, গুরা কালু বাহিনীর ১ জন ও অন্যান্যসহ ১২ বাহিনীর ৯৬ সন্ত্রাসী ১৩টি ৩০৩ রাইফেল, ১টি দোলনা বন্দুক, ১৪১টি একনলা বন্দুক, ২৮টি ৩০৩ রাইফেলের গুলি, ২৫৫টি কার্তুজ ও অস্ত্র তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম জমা দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ বাহিনীগুলো মহেশখালী ও কুতুবদিয়া পাহাড় এবং চ্যানেলে ডাকাতি ও দস্যুতা, পাহাড়ে অস্ত্র তৈরি করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রয় করার কাজে লিপ্ত ছিল। এ ছাড়া নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে একাধিক হতাহতের ঘটনায় জড়িয়ে গিয়ে নিজেরা ডাকাতি করে আসছিল।

আত্মসমর্পণে মধ্যস্থতাকারী বেসরকারি টিভি চ্যানেল আনন্দ টিভির বিশেষ প্রতিনিধি আকরাম হোসাইন জানান, শীর্ষ অস্ত্রের কারিগরদের কারখানা পর্যন্ত পৌঁছাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। কক্সবাজার জেলা পুলিশের সহযোগিতা ও উৎসাহে এ দুঃসাহসিক কাজে সফল হতে পেরে নিজে তৃপ্তি অনুভব করছি। অশান্ত উপকূলকে শান্ত করতে, এলাকার মানুষকে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করতে এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

আত্মসমর্পণকারী জলদস্যু সিরাজোদ্দৌলা বলেন, পুলিশের ভয়ে কখনও পাহাড়ে, কখনও সাগরে জীবনযাপন করেছি। স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। এলাকার লোকজন আমাকে ঘৃণা করে। এসব অপকর্ম ত্যাগ করে জেলা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছি।





০ মন্তব্য

আরও পোস্ট পড়ুন

মতামত দিন