সারাবিশ্বে আতঙ্ক ছড়ানো করোনা ভাইরাস বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় এ ভাইরাস প্রতিরোধে দেশের কয়েকটি এলাকা শাটডাউনসহ সাধারণ মানুষকে নিরাপদে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে সরকার। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি বেসরকারি অফিস ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরমধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের রুটিনওয়ার্ক করে যাচ্ছে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।
হাত ধোয়া ছাড়া তাদের সুরক্ষায় নেয়া হয়নি দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা। সারাদিন জনসেবা দিতে ভিড়ের মধ্যে থাকার পর রাতেও বেশ কয়েকজন মিলে থাকছেন আগের মতো স্বল্প জায়গায়। বিশেষ করে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, মিল ব্যারাক, এপিবিএন ব্যারাকে গাদাগাদি করে থাকছে কয়েক হাজার পুলিশ সদস্য। অবশ্য রাজারবাগে বহিরাগত প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হলেও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক কাজ করছে পুলিশের মাঠ পর্যায়ের অনেক সদস্যের মাঝে।
এদিকে, বিমানবন্দরের পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে (ইমিগ্রেশন পুলিশ) সম্প্রতি কয়েক হাজার বিদেশ ফেরতদের যে তালিকা তৈরি করে সারাদেশে পাঠানো হয়েছে তা তদারকির মূল কাজ করছে মাঠ পুলিশ। বিদেশফেরতরা বাড়ি আছেন কিনা, হোম কোয়ারেন্টাইন মানছেন কিনা, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পেয়েছে পুলিশ। যদিও পুলিশের পারসোনাল প্রটেক্টটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিআই) বলতে কিছুই নেই। ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছে সারাদেশের পুলিশ।
ডিএমপি সদর দপ্তর সূত্রমতে, ডিএমপিতে মোট জনবল প্রায় ৩৪ হাজার। এর মধ্যে রাজারবাগ ১০ হাজার, মিরপুর পুলিশ লাইনে ডিএমপির ৩ বিভাগের প্রায় ১০ হাজার, ডেমরা পুলিশ লাইন্সে প্রায় দেড় হাজার ও ডিপ্লোমেটিক সিটিউরিটি সার্ভিস বিভাগে প্রায় দেড় হাজার পুলিশ সদস্য থাকেন। বাকিরা থানা ও ভাড়া বাসায় থাকেন। সুতরাং করোনা মহামারি আকার ধারণ করলে সবচেয়ে কম সময়ে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলা হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের। এদের অনেককে ফেস মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস দেয়া হলেও তারা যেভাবে মানুষের সংস্পর্শে কাজ করছে তাতে করোনা প্রতিরোধের কোনো সক্ষমতাই নেই। আবার কোনো পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের আলাদাভাবে চিকিৎসার তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। অবশ্য রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে এ ব্যাপারে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়ার খবর জানা গেছে।
রাজারবাগ পুলিশ লাইনে থাকা ৫ জন পুলিশ কনস্টেবল এবং ৩ জন এসআইয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ১ নম্বর গেট প্রবেশের জন্য শিথিল করায় বাকি ৩টি গেট দিয়ে প্রবেশ করছেন পুলিশ সদস্যরা। করোনায় সতর্কতা অবস্থান থেকে প্রতিটি গেটে তাদের শরীরের তাপমাত্রা চেক করা হচ্ছে। পাশাপাশি হাত ধুয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে, তারা আগের মতোই একটি রুমে ৩০-৪০ জন থাকছেন। যদি কোনোক্রমে একবার সেখানকার কারো করোনা হয় তাহলে মুহূর্তের মধ্যে অনেকে আক্রান্ত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
ডেমরা পুলিশ লাইন্সের দুইজন কনস্টেবল ও একজন নায়েক জানান, করোনা ভীতির মধ্যে ঝুঁকি নিয়েই তাদের কাজ করতে হচ্ছে। রাতে আগের মতোই কম জায়গার মধ্যে সবাই থাকছেন। ফেসবুক ও ইউটিউব দেখে যার যার মতো সচেতন থাকার চেষ্টা করছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে হাত ধোয়ার জন্য শুধু কসকো সাবানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যান্য উপকরণ নিজেরা কিনে ব্যবহার করছেন।
প্রায় একই অবস্থা থানা ব্যারাক ও ট্রাফিক পুলিশের। বনানী থানার এসআই এনামুল হক বলেন, যে কোনো ঘটনায় কেউ না গেলেও পুলিশকে বাধ্যতামূলক যেতে হয়। সেক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের পুলিশের নিরাপত্তা নেই। আমরা নিরাপদে কাজ করতে চাই। আমাদের জন্য সে সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হোক। মতিঝিল জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার জাহিদুল ইসলাম সোহাগ বলেন, আমরা নিজস্ব উদ্যোগে সবার জন্য হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেছি। করোনা প্রতিরোধে সদর দপ্তর থেকে অন্যান্য কিছুর ব্যবস্থা করে দিলে আরো ভালো হবে।
এদিকে, সারাদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাজ করলেও একটি মাস্ক ব্যবহার করা ছাড়া তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেই ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের। কয়েকটি ট্রাফিক বক্সে মাস্ক ও গ্লাভস পৌঁছালেও জুটছে না সবার কপালে। ফলে বাধ্য হয়ে নিজ উদ্যোগে হাত ধোয়া ও সচেতন থাকার চেষ্টা করছেন তারা।
ট্রাফিক বিভাগের খিলগাঁও জোনের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মো. জাকির হোসেন বলেন, ট্রাফিক পুলিশকে সারাদিনই রাস্তায় দায়িত্ব পালন করতে হয়। যানবাহনের কাগজ চেক করার জন্য অন্যের সংস্পর্শে যেতে হয়। কিন্তু কার্যত তেমন কোনো ব্যবস্থা আমাদের নেই। নিজ উদ্যোগে ট্রাফিক বক্সগুলোতে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেছি। নয়া পল্টন ট্রাফিক বক্সের সার্জেন্ট জয় সরকার বলেন, পরিবার ও নিজের কথা চিন্তা করে আমরা যতটা সম্ভব নিজ থেকে সতর্ক থাকার চেষ্টা করছি। বাকিটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা। গতকাল রবিবার হাতিরঝিলে করোনা প্রতিরোধে যানবাহনে জীবাণুনাশক স্প্রে করতেও দেখা গেছে।
কোনো পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের জন্য কী প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ড. মো. মনোয়ার হাসনাত খান বলেন, হাসপাতালের ৯ তলায় ১০ ওয়ার্ডের একটি কোয়ারেন্টাইন রেডি রাখা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো করোনা রোগী পাওয়া যায়নি। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্মরত সিনিয়র স্টাফ নার্স শামীমা বলেন, কাউকে করোনা আক্রান্ত বলে সন্দেহ হলে আইইডিসিআরের হটলাইনে ফোন দিয়ে তাদের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হবে।
ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া এন্ড পিআর) মাসুদুর রহমান বলেন, করোনা থেকে সতর্ক অবস্থানের জন্য ইতোমধ্যে থানা এবং ব্যারাকগুলোতে সাধারণ মানুষকে অহেতুক ভিড় করতে দেয়া হচ্ছে না। ব্যারাকগুলোতে গেস্ট আনতেও নিষেধ করা হয়েছে। সবার জন্যই হাত ধুয়ে প্রবেশ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে, বাজারে মাস্ক, হ্যান্ডওয়াশ ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের সরবরাহ কম থাকায় পর্যাপ্ত সরবরাহ করা যাচ্ছে না। চেষ্টা করা হচ্ছে এগুলোর সঙ্গে করোনা প্রতিরোধী পোশাকের ব্যবস্থা করার।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বলেন, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মাস্ক, গ্লাভস ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরবরাহ করে চেষ্টা করা হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের প্রাথমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার। পাশাপাশি পুলিশের কিছু ইউনিট নিজেরাই মাস্ক তৈরি করে সবার কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। নিয়মিত সবাইকে সেলফ প্রটেকশনের বিষয়ে বোঝানো হচ্ছে। এছাড়া কোয়ারেন্টাইনের জন্য আলাদা ইউনিট গঠন করা হচ্ছে।