কাশিয়ানী গ্রামের সাধারণ এক কৃষক পরিবারে নাছিমা বেগমের জম্ম। পরিবারে লেখাপড়ার প্রচলন নাই বললেই চলে। বাড়িতে সৎ মায়ের খোটা দেয়ার পরও চালিয়ে যান লেখাপড়া। মেধা আর খেলাধুলায় দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সবার। ক্লাসে কয়েক গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রথম হন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। পঞ্চম শ্রেনীতে প্রথম হবার পরও কৃষক বাবা আর পড়ালেন না। বাবার যুক্তি মেয়ে এমএ পাশ করার পরও( চুলার ছাই কাড়বে) ভাত রান্না করবে। তাহলে পড়ানোর দরকার কি? মেধাবী শিক্ষার্থীর পক্ষে বাবাকে ষষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তির সুপারিশ করতে গিয়ে ধাওয়া খান শিক্ষকরা বেশ কয়েকবার। অবশেষে শিক্ষকরা হাল ছেড়ে দেন। এভাবে যাবনিকা হয় কৃষকের মেয়ের লেখাপড়া।
মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসতে বাধ্য করা হয়। পাত্র একই গ্রামের ছেলে মীর শওকত আলী, বেকার ছাত্র। সৎ শ্বাশুড়ির সংসারে কোনভাবে কেটে যায় দিন। স্বামী শিক্ষা বিস্তার ও বেকার জীবন ঘোচানোর জন্য কাশিয়ানী থানার পাশে কয়েক বন্ধু মিলে গড়ে তোলেন প্রাইমারী স্কুল। সরকারি অনুদানের ১২৫ টাকয় চলে যাচ্ছিল সংসার কোনভাবে। নুন আনতে পান্তা না ফুরালেও সংসারে ছিল নানা অনটন। এর মধ্যে মাত্র ১৪ বছর বয়সে পুত্র সন্তানের জননী হন। অপ্রাপ্ত বয়সে বাচ্চা হওয়ায় প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুটা সুস্থ হতে না হতেই চলে মুক্তি যুদ্ধের দামামা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সবাই যোগ দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে দেশকে স্বাধীন করতে। কোলে শিশু বাচ্চা, চোখে পানি আর অজানা ভবিষ্যত সামনে নিয়ে স্বামীকে পাঠান দেশ হানাদার মুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধে। নিজে গ্রামে থেকে মুক্তিযোদ্ধােদের সহয়তা করেন তিনি বিভিন্ন ভাবে। ভারতে ট্রেনিং শেষে দেশে এসে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হন। ১৯৭১ সনের ১৮ জুলাই সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন স্বামী। শহীদ হওয়ার খবরটি বাড়িতে পৌছায়নি।
দেশকে স্বাধীন করে মুক্তিযোদ্ধারা একে একে ঘরে ফেরা শুরু করে। নাছিমা বেগম অপেক্ষা করে তার স্বামী ফিরবে। বিধিবাম অবশেষে সেই হৃদয় বিদারক খবরটি আসে। তার স্বামী শহীদ হয়েছেন। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ছেলে জীবিত নেই তাই এই অজুহাতে শ্বশুর তাড়িয়ে দেন বাড়ি থেকে। আশ্রয় হয় বাপের বাড়িতে। ছেলে নিয়ে দিশেহারা কি করবে এখন? একদিকে নিজের খাওয়া, অন্যদিকে শিশু সন্তান পালন। অন্যের বাড়িতে কাজ করে যে খাবার পেতেন নিজে না খেয়ে শিশু সন্তানকে খাওয়াতেন। সন্তানকে বাবামায়ের কাছে রাখার অপরাধে ভাইরা বাবা মায়ের খরচ বন্ধ করে দেয়। পরিবারের সদস্য সংখ্যা হয় চারজন।
কচুর খাটা আর কলাগাছের থোড় খেয়ে কত দিনই বা থাকা যায়। শুরু করলেন আরেকটু যুদ্ধ। বাসায় যেয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ানো। আর এই সামান্য অর্থ দিয়ে সংসার চলে যাচ্ছিল কোনভাবে। চালিয়ে যান ছেলের লেখাপড়া ও। গ্রামের স্কুল কলেজ শেষ করে ছেলেকে পড়ান প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ছেলের লেখাপড়া আর সংসার চালানোর জন্য কোনদিন হাত পাতেন নি কারো কাছে। ধারও করেননি কখন ও। উপরন্তু গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের পড়িয়েছেন বিনা পয়সায়। গ্রামের মেয়েদের দিয়েছেন কোরআন শিক্ষা। সম্পৃক্ত হয়েছেন সামাজিক কর্মকান্ডে। জনপ্রতিনিধি হয়েছেনও একবার।
ছেলে লেখাপড়া শেষ করে ২২ তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে চাকুরী পেয়েছে। মায়ের কি আনন্দ। চোখে যুদ্ধ জয়ের আনন্দ অশ্রু। ছেলে বাংলাদেশ সরকারের একজন উপসচিব। তিনি বসে নাই। গ্রামের ছেলেমেয়েদের মাঝে শিক্ষা বিস্তারে কেটে যায় তার অধিকাংশ সময়।
ডিসেম্বর আসলেই মনের মধ্যে ভেষে বেড়ায় স্বাধীনতার গল্প, স্বামী হারানোর বেদনা আর জীবন সংগ্রাম। ডিসেম্বর মানেই তার কাছে বিজয়। সে বিজয় দেশ মাতৃকার। সে বিজয় জীবন সংগ্রামের। তিনি মা, তিনিই জয়িতা।
লেখক: সৈয়দ ফারুক আহম্মদ,ডেপুটি সেক্রেটারি,বিসিএস (এডমিন) ২২ তম ব্যাচ।