“২৫ মে ২০০৯ এর সুপার সাইক্লোন আইলা”
আগ থেকেই বার্তা ছিল আইলা আসছে। প্রস্তুতিও নেয়া হয় জেলা,উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে। সভা করা হলো।স্বেচ্ছা সেবক প্রস্তুতি নেয়া হলো,ইভাকোয়েশনের জন্য মাইকিং করা হলো, আশ্রয় শিবির খোলা হলো।
আগের গভীর রাতে ৩ নম্বর সিগনাল শুনে রাতে বাসায় গেলাম।ভোর রাতে কন্ট্রোল রুম থেকে ফোন এলো মহাবিপদ সংকেত ৭। তাড়াতাড়ি অফিসে গিয়ে সবাইকে সতর্ক করা ও যোগাযোগ করা হলো।দমকা বাতাস ও ভারী বৃষ্টি ততক্ষনে মারাত্মক আঘাত হানছে
উপকূলে। সাতক্ষীরা শহরেও প্রচন্ড হাওয়া ও ভারী বৃষ্টি।বিদ্যুৎ চলে গেছে।টেলিফোনে ও ফ্যাকসে খবর জানালাম।
সকাল গড়িয়ে দুপুর এবং বিকাল।আঘাত প্রতি মুহুর্তে তীব্র হচ্ছে।শ্যাম নগরের গাবুরা ও পদ্মপুকুর থেকে অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে গেলেন না।পুলিশ নামিয়ে চেষ্টা করা হলো।বিজিবি,নৌবাহিনীর জাহাজ গাবুরার পাঠাতে অনুরোধ করলাম।
সন্ধ্যার পরপর আইলার বেগ প্রায় ১৬০-১৮০ কিমি।যারা ঘরবাড়ীর মমতা ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে আসেননি তাদের মধ্যে থেকে ৫৯ জন মারা গেল।
সেই রাত ছিল আমার জীবনের কঠিনতম সময়।সরকারের বিভিন্ন দপ্তর সংস্থা থেকে অজস্র ফোন ,অন্য প্রান্তে শ্যামনগর আশাশুনির মানুষের আহাজারি।
রাত ১টার দিকে আমি শ্যামনগরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।তখনো বাতাস ও ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। পৌর মেয়র শেখ আশরাফুল হক,অজেপ্র মুকেশ চন্দ্র বিশ্বাস নিষেধ করলেন এ সময় না যাওয়ার জন্য। আমি সদরের ইউএনও সুলতান আলমকে সাথে নিয়ে বের হলাম।গাড়ী ঝড় ও বৃষ্টির মধ্যে আগাচ্ছে না,গাড়ী উল্টে যাওয়ার মতো অবস্থা।মাঝে মধ্যে গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ, লোকজনকে বলে কুড়ালে কেটে গাড়ী আগাচ্ছে।শ্যামনগর পৌঁছলাম অবশেষে।দিলীপ কুমার বনিক ইউএনও রিসিভ করলেন।খোলপেটুয়ার কাছে গেলাম।সে কী ভীষন রূপ খোল পেটুয়ার।গোখরোর ফনার মতো ৭-৮ ফুট উচুতে উঠে গেছে,সমুদ্রের মতো বিস্তৃত।সংহার মূর্তি খোলপেটুয়ার।
স্পীড বোটের চালক কুদ্দুসকে বললাম ,চলো ওপাড়ে গাবুরাতে।
কুদ্দুস বিনয়ী কর্মী।বললে,স্যার আপনিও মারা যাবেন,আমিও মারা যাবো।
ফিরে আসলাম।নৌবাহিনী রাতে পৌঁছতে পারলো না।পরের দিন আসলো।
কয়েক লক্ষ
মানুষের বাড়ী ঘর ধ্বংস।কয়েক লক্ষ গরু,মহিষ,ছাগল,হাঁস মুরগী,পাখী মারা গেল।
মানুষের লাশ দাফন করা হলো ।সাতক্ষীরা শহর থেকে মেথর এনে মৃত প্রানীদের কবর
দেয়া হলো।মৃত উলংগ শিশুদের লাশের সারি এখনো চোখে ভাসে।
শ্যমনগরে কোন মিঠা পানি নেই। সাতক্ষীরা পৌরসভার পানি ১০ টনের কয়েকটি ট্যাংকারে করে শ্যামনগর পাঠানো হল।
শ্যামনগর থেকে আশাশুনি যখন পৌঁছলাম রাস্তায় হাটু পানি,ইউএনও মোস্তফা জামানের বাসায় কোমর পানি।সাতক্ষীরা শহরে পৌঁছালে ফজরের আযান হচ্ছে।জেলা প্রশাসকের বাংলোতে গাছ ভেংগে পড়ছে।গাড়ী ঢুকতে পারছে না।
বাসায় কিছু সময় ব্যয় করে অফিসে চলে গেলাম ।রিপোট করলাম।কাজ ভাগ করে কর্মকর্তা নিয়োগ করলাম।সংবাদ কর্মীরা কাদাপানিতে নেমে জাতীয় ও স্থানীয়মিডিয়ায় গভীর সংবেদনশীল প্রতিবেদন ছাপলেন।
মাননীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী অধ্যাপক আ ফ ম
রুহুল হক জেনেভা থেকে ছুটে
আসলেন। মাননীয় খাদ্য মন্ত্রী ড: আবদুর রাজ্জাক,মহাপরিচালক খাদ্য সহ আসলেন পরিস্তিতি দেখতে।বিজিবির কর্নেল আমীর মোহাম্মদ আরিফ অনেক কষ্ট করেছেন।
জেলা প্রশাসন সহ অন্য বিভাগের সহকর্মীরা কঠোর পরিশ্রম করে কিছুটা দু:খ লাঘব করলেন।
জনপ্রতিনিধি গন প্রচুর পরিশ্রম করেছন।এককথায় সবার সহযোগিতা পেয়েছি।
আজ সবাইকে জানাই অভিবাদন।
যারা মৃত্যুবরণ করেছেন। আল্লাহ যেন তাদেরকে জান্নাত মন্জুর
করেন ।আল্লাহ যেন সাতক্ষীরার মানুষকে শান্তি ও সমৃদ্ধি দান করেন।
এক পর্যায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্যমনগর এলেন কুড়ি হাজার করে টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের বিতরনের জন্য।বৃষ্টি বর্ষণ মুখর সেই দিনে কলেজের একটি কক্ষে ঘূর্নিঝড়ের তান্ডব ও ভয়াবহতা এবং পুনর্বাসন কর্মসূচী উপস্থাপন করলাম তখন তিনি চোখের জল মুছতে লাগলেন।আমার মতো নগন্য একজন মানুষ অনন্য
এই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকলাম।
একদিন সারাদিন ধরে রিলিফ অপারেশন করছি।মাননীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রীর নেতৃত্বে। দুপুরে খাওয়া হয়নি একটা আপেল ছিল সন্ধ্যা বেলায় ভাগ করে খেলাম।
লিখলে বই হয়ে যাবে সব কথা লিখা সম্ভব হলো না।
লেখক: মোঃ আবদুস সামাদ,এসডিএফ চেয়ারম্যান ও সাবেক জেলা প্রশাসক সাতক্ষীরা, সাবেক বিভাগীয় কমিশনার খুলনা ও অবসর প্রাপ্ত সিনিয়র সচিব,নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়।