দেবহাটা সীমান্তের ইছামতি নদীর দু’পাড়ে ভারত ও বাংলাদেশের হাজার হাজার দর্শণার্থীদের উৎসাহ, উদ্দীপনা আর অশ্রুসিক্ত নয়নে দেবী দূর্গার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যদিয়ে শেষ হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দূর্গা পূজা। সাথে সাথে এবারও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সৌহাদ্য ও সম্প্রতির মেলবন্ধন বিজড়িত মিলন মেলা থেকে বঞ্চিত হলেন দু’দেশের মানুষ।

শুক্রবার সন্ধ্যায় স্ব স্ব সীমারেখার মধ্যে প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে দেবী দূর্গাকে বিদায় জানান দুই বাংলার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। এরআগে দুপুর থেকে ইছামতির দুপাড়ে জড়ো হতে শুরু করেন হাজার হাজার ভক্ত ও দর্শণার্থীরা। বিকেলে দেবহাটা উপজেলার বিভিন্ন মন্ডপের পাশাপাশি ভারতের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হাসনাবাদ, টাকী ও হিঙ্গলগঞ্জসহ আশপাশের এলাকার মন্ডপ থেকে দেবী দূর্গার প্রতিমা নিয়ে বিসর্জনস্থলে পৌঁছান দু’দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে ইছামতির উভয় পড়ের বেঁড়িবাধে ছিল আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর টহল। তাছাড়া ইছামতি নদীর জলসীমার নোম্যান্স ল্যান্ড বরাবর রশি টাঙিয়ে এবং সারি সারি নৌকা দিয়ে অস্থায়ী ব্যারিকেড স্থাপন করেন দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও বিএসএফ। কেবলমাত্র গণমাধ্যম কর্মীদের বহনকারী দেবহাটা প্রেসক্লাবের একটি ট্রলার ব্যাতীত অন্য কোন জলযানকে অনুমতি না থাকায় নামতে দেয়া হয়নি ইছামতি নদীর বাংলাদেশ সীমানায়।

প্রতিমা বিসর্জনকালে বাংলাদেশে পাড়ে সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(অপরাধ ও প্রশাসন) মো:সজীব খান, দেবহাটা সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার এসএম জামিল আহমেদ, নির্বাহী অফিসার এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী, জেলা ডিবির ওসি ইয়াছিন আলম চৌধুরী, দেবহাটা থানার ওসি শেখ ওবায়দুল্লাহ, সদর ইউপি চেয়ারম্যান আবু বকর গাজী এবং ভারতের পাড়ে টাকী পৌরসভার চেয়ারম্যান সোমনাথ চ্যাটার্জী সহ সেখানকার প্রশাসনিক অফিসাররা উপস্থিত ছিলেন।

সম্প্রতি কুমিল্লায় কোরআন শরীফের অবমাননা নিয়ে দেশের বেশ কিছু জেলাতে পুজামন্ডপে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলেও সাতক্ষীরা জেলায় কোন রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শান্তিপূর্ণ ভাবে বিজয়া দশমী উদযাপিত হয়েছে।আর এটি সম্ভব হয়েছে সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান পিপিএম-বার এঁর দক্ষ নেতৃত্বের কারনে। কারন ষষ্ঠী পুজা থেকেই সাতক্ষীরার পুলিশ সুপারের নির্দেশনা মোতাবেক ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) সজীব খানের সার্বিক তত্বাবধানে  জেলা গোয়েন্দা শাখার অফিসার ইনচার্জ ইয়াছিন আলম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ডিবি পুলিশের ৩টি ইউনিট বিজয়ী দশমী পর্যন্ত জেলার ৮টি থানার পুজামন্ডপ এলাকায় নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে পেট্রোল ডিউটি করেছে।এছাড়া জেলার আটটি থানার অফিসার ইনচার্জ গণ নিজ নিজ এলাকায় পুজামন্ডপের  নিরাপর্ত্তা জোরদার করে শুক্রবার শান্তিপূর্ণ ভাবে বিজয়ী দশমী উদযাপিত করতে সর্বাত্মক সহযোগীতা করেছেন।একারনে জেলা পুজা উদযাপন কমিটি সাতক্ষীরা জেলা পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞা প্রকাশ করেছেন।

উল্লেখ্য, দেশ বিভাগের পর থেকে ভারতের টাকী ও বাংলাদেশের দেবহাটা উপজেলার টাউনশ্রীপুরে দু’দেশের আর্ন্তজাতিক সীমানা নির্ধারণী ইছামতি নদীতে একসাথে দেবী দূর্গার প্রতিমা বিসর্জন দেন দুই বাংলার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

প্রতিমা বিসর্জনকে ঘিরে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশ ও ভারতের লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে যুগযুগ ধরে ইছামতি নদী পরিনত হতো দুই বাংলার সৌহাদ্য ও সম্প্রীতির মেলবন্ধনে ভরা মিলন মেলায়। নদীতে ভেঁসে বেড়াতো দু’দেশের দর্শনার্থীতে ভরা কয়েক হাজার ছোট বড় জলযান। আর্ন্তজাতিক সীমারেখা ভুলে মিলন মেলার বাঁধভাঙা আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠতো আলাদা আলাদা রাস্ট্রে বসবাসকারীরা।

করতো ভাবের আদান প্রদান, বিনিময় হতো বাহারি মিষ্টি, মৌসুমি ফল ও ফুল। বছরের ওই একটি দিনে ইছামতি নদীতে থাকতো কোন আইনের বাধ্য বাধকতা। পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই কয়েক ঘন্টার জন্য বাংলাদেশের মানুষ ভারতে এবং ভারতের মানুষ বাংলাদেশে ঢুকে পছন্দের পন্য কেনাকাটা করে আবার সন্ধ্যার আগে যে যার দেশে ফিরে যেতো। পরিবার পরিজন নিয়ে মিলন মেলায় অংশ নিতেন দু’দেশের উচ্চ পদস্থ অফিসাররাও।

পৃথক দু’টি রাস্ট্রের সৌহার্দ ও সম্প্রীতির এমন নজির বিহীন মিলন মেলা বাংলাদেশ ও ভারতের সংবাদ মাধ্যমের পাশাপাশি গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হতো আর্ন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও। কিন্তু দু’দেশের আইনী জটিলতা ও উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের কারনে ২০১৭ সালের পর থেকে ইছামতির ওই ঐতিহ্যবাহী মিলনমেলা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে বাংলাদেশ ও ভারতের লাখ লাখ মানুষ। এবারও মিলন মেলার আনন্দ উল্লাস থেকে বঞ্চিত হয়ে সন্ধ্যার পর অশ্রুসিক্ত নয়নে স্ব-স্ব সীমারেখায় প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দেবী দূর্গাকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ফিরে যান দু’দেশের হাজার হাজার ভক্ত ও দর্শণার্থীরা।





০ মন্তব্য

আরও পোস্ট পড়ুন

মতামত দিন