পুলিশ সম্পর্কে জনমনে এখনো নেতিবাচক ধারণা বিদ্যমান। অথচ আইজিপি ও নবনিযুক্ত ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা অধিকাংশ কর্মকর্তাই সৎ। এসব সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা কি পারবেন পুলিশে সততা-নিষ্ঠা ফিরিয়ে এনে বাহিনীর গতিকে ত্বরান্বিত করতে এবং জনসাধারণের ধারণা বদলে দিতে?

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশের শীর্ষ কর্তারা যদি সৎ হন, তবে এর ইতিবাচক প্রভাব ডিপার্টমেন্টে কমবেশি পড়ে। আর যদি গোড়ায় গলদ বা মাছের পচন যেমন মাথা থেকে ধরে তেমনি ওপরের সারির কর্মকর্তারা যদি অসৎ হন, তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব নিচের দিকেও পড়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা অবতীর্ণ হওয়ার অভিযোগ বিস্তর। যদিও জীবনে ঘুষ খাননি এমন পুলিশ কর্মকর্তাও এখন পুলিশ বাহিনীতে প্রচুর রয়েছে।

সূত্র জানায়, বর্তমান আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী গত বছর ২ ফেব্রুয়ারি আইজিপি হিসেবে যোগ দেন। দায়িত্ব নিয়েই পুলিশের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। কথায় সীমাবদ্ধ না থেকে তিনি কাজেও প্রমাণ দেন পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে দুর্নীতি বন্ধ করে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক আইজিপি মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী বলেন, আইজিপি কনস্টেবল নিয়োগে যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা পুলিশ বাহিনীর জন্য একটা কালজয়ী উদাহরণ হয়ে থাকবে। ঘুষ-দুর্নীতি মুক্ত থেকে পুলিশের চাকরি এটা যেন অবাস্তব ছিল বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে। দৃঢ়তা ও সততার কারণেই আইজিপি এটা পেরেছেন।

এ রকম বাহিনীর শীর্ষপদগুলোতে যত পেশাদার, দক্ষ ও অপেক্ষাকৃত সৎ কর্মকর্তারা আসবেন পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি জনমনে ততই বাড়বে।

তিনি আরো বলেন, পুলিশের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা হলো, পুলিশ নিরপেক্ষ ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু যে সমাজ থেকে পুলিশ সদস্যদের বাছাই বা নিয়োগ করা হয়, সেই সমাজটিই যদি নিরপেক্ষ না হয়, সেখানে যদি ন্যায্যতার কোনো বালাই না থাকে, তখন?

এ কথা অনস্বীকার্য যে পুলিশের আচরণ সমাজের পক্ষপাতিত্ব ও পূর্বসংস্কারেরই প্রতিফলন। এই পূর্বসংস্কারগুলোকে আমরা কেউ কেউ বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করি। পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পেশাদারিত্ব চর্চার সুযোগ দিতে হবে।

পুলিশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংস্কৃতি হচ্ছে, পুলিশ বিরোধী রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের দমনপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। যতদিন এটা বন্ধ না হবে, যতদিন রাজনৈতিক দলগুলোর শুভবুদ্ধির উদয় না হবে, ততদিন পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করা আর বোকার স্বর্গে বাস করা-একই কথা।

তথ্যানুসন্ধানে আরো জানা গেছে, নবনিযুক্ত ডিএমপি কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম, পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধান মীর শহিদুল ইসলাম ও নবনিযুক্ত সিআইডি পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। এরা জীবনে কোনোদিন ঘুষ খাননি বলে পুলিশ বাহিনীতে আলাদা সুনাম আছে। প্রায় দুই কোটি মানুষের নিরাপত্তায় রয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। পুলিশ কমিশনার সৎ হলেই যে ডিএমপির সবাই রাতারাতি সৎ হয়ে যাবে বা ঘুষ খাওয়া বন্ধ করে দেবে-এ রকমটাও প্রত্যাশা করা ঠিক হবে বলে মনে করছেন না অপরাধ বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ডিএমপির শীর্ষ কর্মকর্তা যদি ঘুষ না খান, তার ইমেজ যদি ক্লিন হয়, তাহলে এর একটা প্রভাব পড়ে বাহিনীতে। অধীনস্ত যারা ঘুষ দুর্নীতিতে যুক্ত থাকেন, তারা অনেকটা সতর্ক হয়ে যান। এর সুফল ও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে সমাজে ও জনমনে। শুধু তাই নয়, দিন যত যাচ্ছে পুলিশ বাহিনীতে অপেক্ষাকৃত যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তাদের সংখ্যা বাড়ছে। আর এসব কর্মকর্তাই ঘাপটি মেরে থাকা অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শত বাধা ডিঙিয়ে বাহিনীকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে অপরাধ বিশ্লেষক ও সাবেক আইজিপি এ কে এম নুরুল হুদা বলেন, পুলিশকে পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পুলিশের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মধ্যে দুটি ধারা থাকে। সেই দুটি ধারা হচ্ছে উভয় দিকে ধারাল তরবারির মতো ভয়ংকর। এর পরিণতিও থাকে সুপ্ত অবস্থায়। এর একটি হলো মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা এবং সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতার অপরিহার্যতা।

অন্যটি হচ্ছে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অপব্যবহারের ঝুঁকি। এই ক্ষমতার অপব্যবহার নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ক্ষতির কারণ হতে পারে। এমনকি গোটা সমাজের ওপর এই ক্ষমতার অপব্যবহার নেতিবাচক প্রভাবও ফেলতে পারে। জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি শুধু একটি আধুনিক পুলিশ সংগঠনই নয়; জনগণের প্রত্যাশা একটি সদাচারী, নিরপেক্ষ, দক্ষ ও পেশাদার পুলিশ সার্ভিস।

শুধু আধুনিক অস্ত্র, বিলাসবহুল গাড়ি, সুসজ্জিত অফিস, পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা কিংবা পিটি-প্যারেডনির্ভর প্রশিক্ষণ কোনো পুলিশ সংগঠনকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে না। এর জন্য চাই পুলিশের ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিবর্তন। বিগত দুই বছর কনস্টেবল নিয়োগকে স্বচ্ছতার সঙ্গে দুর্নীতি মুক্ত করে আইজিপি সেই পরিবর্তনের একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। এই ইঙ্গিত পরিবর্তনের জন্য। এর জন্য দরকার সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছা।

সরকার যদি পুলিশকে লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়া অব্যাহত রাখে এবং রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে, পুলিশের এসপিরা যদি মাঠপর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের আরো বেশি বেশি নজরদারির আওতায় আনেন, যদি পুলিশ ঘুষ ছাড়া চাকরিতে প্রবেশ করতে পারে, থানায় আসা মানুষ যদি বিনা হয়রানিতে আইনগত সহায়তা পায়, তাহলেই দিন যত যাবে পুলিশ ততই মানুষের আস্থা অর্জনের পথে অনেকটা এগিয়ে যাবে।





০ মন্তব্য

আরও পোস্ট পড়ুন

মতামত দিন