সাতক্ষীরায় দুই দশক আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় করা অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলায় বিএনপির সাবেক এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ ৪ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) সকাল ১১টায় সাতক্ষীরা স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক বিশ্বনাথ মন্ডল এ রায় ঘোষণা করেন।
মামলার অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের পৃথক দুটি অংশের প্রত্যেকটিতে সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি হাবিবুল ইসলাম হাবিব, উপজেলা যুবদলের সভাপতি আব্দুল কাদের বাচ্চু, পৌর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান রনজু ও সাবেক ছাত্রদল সভাপতি রিপনকে যাবজ্জীবন এবং অপর ৪৪ জন আসামির প্রত্যেককে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সাতক্ষীরা জজ কোর্টের পিপি অ্যাডভোকেট আব্দুল লতিফ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এই রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ খুশি। এই রায়ের মাধ্যমে আজ সাতক্ষীরা কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।’
আসামিদের মধ্যে একই ঘটনা থেকে উদ্ভূত অপর একটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে থাকা ৩৭ জন ও জামিনে মুক্তি পাওয়া একজন আদালতে হাজির ছিলেন। অন্যরা পলাতক রয়েছেন।
এ ঘটনায় করা মামলার দণ্ডবিধি অংশে ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ ৫০ জন নেতাকর্মীকে চার থেকে ১০ বছর মেয়াদে সাজা দেন সাতক্ষীরার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হুমায়ুন কবির। আসামিদের মধ্যে দুজন দণ্ড ভোগ করা অবস্থায় কারাগারে মারা যান।
আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আমিনুল ইসলাম। তার সঙ্গে আরও যুক্ত হন আইনজীবী আবদুল মজিদ, মিজানুর রহমান ও শাহানারা পারভিন প্রমুখ। রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন জজ আদালতের সরকারি আইনজীবী (পিপি) আবদুল লতিফ, অতিরিক্ত সরকারি আইনজীবী ফাহিমুল হক, আইনজীবী আবদুস সামাদ প্রমুখ।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০০২ সালের ৩০ আগস্ট ধর্ষণের শিকার এক নারীকে দেখতে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে যান। সেখান থেকে যশোরে ফিরে যাওয়ার পথে কলারোয়ায় বিএনপির সভাপতি ও তৎকালীন সংসদ সদস্য হাবিবুল ইসলামের হাবিব ও বিএনপি নেতা রঞ্জুর নির্দেশে বিএনপি ও যুবদলের নেতাকর্মীরা হামলা চালান। এ সময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রকৌশলী শেখ মুজিবুর রহমানকে গাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে মারপিট করা হয়। এ সময় শেখ হাসিনার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
এ ঘটনায় কলারোয়া থানা মামলা না নেওয়ায় ২ সেপ্টেম্বর কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোসলেমউদ্দিন বাদী হয়ে ২৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৭০/৭৫ জনকে সাতক্ষীরা নালিশি আদালতে মামলা করেন। মামলায় ১৮ জনকে সাক্ষী করা হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০০৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঘটনা মিথ্যা বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
বাদী মোসলেম উদ্দিন পুলিশ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালের ২২ জানুয়ারি আদালতে নারাজির আবেদন জানালে শুনানি শেষে তা খারিজ হয়ে যায়। এ খারিজ আবেদনের বিরুদ্ধে বাদী ২০০৪ সালের ১১ এপ্রিল জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলা করেন। ২২ এপ্রিল শুনানি শেষে বিচারক এ রিভিশন আবেদন খারিজ করে দেন। ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট বাদী এ আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে ক্রিমিনাল মিস কেস দাখিল করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে আদালত ২০১৩ সালের ১৮ জুলাই আপিল মঞ্জুর করে নিম্ন আদালতের আদেশের উপর স্থগিতাদেশ দেন। একই সঙ্গে নিম্ন আদালতে মামলার কার্যক্রম নতুন করে শুরু করার করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
বাদীর উপস্থিতিতে নারাজি শুনানি করার জন্য মুখ্য বিচারিক হাকিম নিতাই চন্দ্র সাহা ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর দিন ধার্য করেন। ওই দিন বিচারক শুনানি শেষে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কলারোয়া থানার ওসিকে নির্দেশ দেন। ওই দিনই মামলাটি থানায় রেকর্ড হওয়ার পর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) শফিকুর রহমানকে তদন্তকারি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে সাড়ে ছয় মাস পর ২০১৬ সালের ৪ মে তিনি আদালতে ৫০ জনের নামে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
২০১৯ সালে মামলাটির দন্ডবিধির অংশ নতুন করে সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে এলে ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি অভিযোগপত্রে উল্লেখিত ৫০ জন আসামিকে চার থেকে ১০ বছর মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।
অপরদিকে মামলার অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের এসটিসি ২০৭/১৫, ২০৮/১৫ এ দুটি মামলায় ১৫ জন সাক্ষী দেন। সাক্ষ্য চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষে অবস্থানকারী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম মুনিরকে হুমকি দেওয়ায় জজ কোর্টের পিপি আব্দুল লতিফের সদর থানার সাধারণ ডায়েরির তদন্তে বিএনপি নেতা হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে নন জিআর মামলা হয়। যা আজও চলছে।
যুক্তিতর্ক শেষে সাতক্ষীরার স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক বিশ্বনাথ মন্ডল আজ রায় ঘোষণা করেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী শাহানারা পারভিন বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করবো।’