“কত মানুষ মরিয়াছে, কত মানুষ বিশ্রীভাবে মরিয়াছে, কত মানুষ ইচ্ছা করিয়া মরিয়াছে-আর কত মানুষ অন্য মানুষের দুস্কার্যের জন্য মরিতে বাধ্য হইয়াছে”- আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে সাংবাদিক ও সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের এই কথাগুলো প্রায়ই আমার মনে হয়। যদিও তিনি কালের সাক্ষী বহমান তিতাস নদীকে কেন্দ্র করে খেটে খাওয়া মানুষের যাপিত জীবনের চিত্রায়ণের প্রয়াস পেয়েছেন, তথাপি, এটি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ও মিলিয়ে নিলে ভুল হবে না। কেননা, মরণ জীবনেরই অনিবার্য পরিণতি। জীবন থাকলেই মরণ হবে, এ দায় কারুরই এড়ানোর জো নাই। শুধু কি মানুষ, জীবন আছে এমন পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, গাছপালা সকলেই একদিন মরনকে বরন করবে তা সে চাক বা নাচাক। অথচ মানুষ মরনকে এড়াতে কতই চেষ্টা তদবির চালায়, প্রাণিকূলও তো তাই। কিন্তু মরন থেকে কোনভাবেই রেহাই নাই। “জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে, চিরস্থির কবে নীর হায়রে জীবন নদে।” প্রাগৈতিহাসিক কাল ধরেই এই নিয়ম চলছে, চলবেও যতদিন একজন ও জীবিত থাকবে। পৃথিবীর প্রথম যে প্রানের আবির্ভাব হয়েছিল, সে প্রানের ও পরিসমাপ্তি হয়েছে মরনে। “যারা জন্মেছিল আমাদের বহুদিন আগে, যারা দেবতার পুত্র, যারা সব দেবতার মতো, তারাও পায়নি মুক্তি জরা থেকে, দুঃখ থেকে, তাদেরও জীবনে মৃত্যু এসেছিল একদিন”- আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে গ্রীক কবি Simonides এ সত্যি অনুধাবন করেছিলেন। সত্যিই তো, আমার বাবা মরেছে, তার বাবা মরেছে, মরেছে তারও বাবা। আবার আমিও মরব, আমার সন্তান ও একদিন মারা যাবে, মারা যাবে তারও সন্তান। কেননা, মৃত্যু জন্মের মতই সত্যি। পবিত্র কোরআন শরীফে বলা হয়েছে, “জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে” (সূরা আল-ইমরান-১৮৫; সূরা আল-আম্বিয়া- ৩৫ এবং সূরা আল-আনকাবুত-৫৭)। Tawrat, Zabur এবং Injil কিতাব সমূহেও জীবিত প্রাণীর মৃত্যুর বিষয়ে বলা আছে বলে জানা যায়। সনাতন ধর্ম কিংবা বৌদ্ধ ধর্মসহ প্রচলিত প্রায় সব ধর্মেই মৃত্যুর অনিবার্যতার বিষয়ে মতপার্থক্য না থাকলেও মৃত্যুর ধরণ কিংবা মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে।
বর্তমান বিশ্বে গড়ে প্রতিদিন এক লাখ পঞ্চান্ন হাজার পাঁচশত বিশজন এবং বছরে পাঁচ কোটি সাতষট্টি লাখ চৌষট্টি হাজার আটশো জন মানুষ মারা যায়। সে হিসেবে Human Species জন্ম নেওয়ার পর থেকে কত মানুষ মারা গিয়েছে সে হিসেব বের করা কঠিন কাজ। অথচ মৃত্যুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোন মানুষের কথা কোথাও শুনি নাই। ধর্মবিশ্বাসীগণ মৃত্যুর কারন, ধরণ এবং মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে স্ব স্ব ধর্ম গ্রন্থের বিবরণ প্রশ্নাতীতভাবেই বিশ্বাস করেন। পক্ষান্তরে, সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে যারা বিশ্বাসী নয় অর্থাৎ বিধর্মী, তারা মৃত্যু কিংবা মৃত্যু পরবর্তী অবস্থার বিষয়ে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা যাচাই বাছাই শেষে গ্রহণ করেন। বিভিন্ন দেশের পৌরানিক কাহিনীগুলোতেও মৃত্যুর ধরণ এবং মৃত্যু পরবর্তী পর্যায় নিয়ে নানা রকম আলোচনা কয়েছে। সৃজনশীল কবি, সাহিত্যিক, দার্শণিক এবং শিল্পীরা ও নিজেদের মতো করে মৃত্যু ব্যাখ্যা করেন। মরমী কবি জালালুদ্দিন রুমী যেমন বলেন, “যখন দেখবে আমার মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে, তুমি কেঁদোনা-
আমি কোথাও যাচ্ছি না, আমি কেবল পৌঁছে যাচ্ছি অনন্ত প্রেমে।” আবার গ্রীক কবি Sappho (খ্রীষ্টপূর্ব ৬১২) সেই যুগে লিখে গেছেন, “মৃত্যু এক অভিশাপ, একথা জানেন দেবগণ, তা নাহলে বহুকাল আগে হতো তাঁদের-ই মরণ।” রবীন্দ্রনাথ যা বলে গেছেন আমি সেভাবে বুঝি না, “মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান। মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজূট, রক্তকমলকর, রক্ত-অধরপুট, তাপবিমোচন করুন কোর তব, মৃত্যু অমৃত করে দান।”
মানুষ মরেছে, মরছে এবং মরবেই। বার্ধক্যজনিত কারনে মানুষ মরে, দূর্ভিক্ষে জীবন যায়, বিভিন্ন রোগ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, মহামারীতে কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। আবার মানুষের দূষ্কর্মের কারনে যেমন, হত্যা, সংঘর্ষ, যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ, গণহত্যার শিকার হয়েও অগণিত মানুষ মারা যায়। জলে, স্থলে এবং আকাশপথেও দূর্ঘটনায় মানুষের মরণ হয়। জন্ম যেমন থেমে থাকেনা, তেমনি মৃত্যুরও বিরাম নাই, প্রতি সেকেন্ডেই মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। চলতি বছরে গত কয়েক মাস নিয়মিত মৃত্যুর পাশাপাশি অদৃশ্য এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের কারনে সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারীতে মৃত্যুর মিছিল বেশ কিছুটা লম্বা হচ্ছে প্রতিদিনই। আমাদের সংস্কৃতিতে যেমন একটা কিতাবী নাম আর একটা ডাক নাম থাকে, তেমনি, করোনার কিতাবী নাম ‘SARS-CoV-2’ হলেও বিশ্ববাসী Covid-19 বা করোনা রোগ নামেই বেশী চেনে। ২০১৯ এর শেষদিকে চীনের উহান উৎপত্তিস্থল হলেও ইতোমধ্যেই বিশ্বের ২১৩ টি দেশ এবং ভূ-খন্ডে Covid-19 ছড়িয়ে পড়েছে। আজ পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ লাখ ৮৫ হাজার ৯৯৪ জন এবং বিশ্বে মারা গেছে ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৪৪৭। শত বছর আগের মহামারী স্প্যানিশ ফ্লুর বিস্তার সবচেয়ে বেশী হয়েছিল ইউরোপ এবং আমেরিকা অঞ্চলে, এবারেও ইউরোপ এবং আমেরিকার মত দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশী মানুষ আক্রান্ত এবং মৃত্যু বরণ করেছে। এখন পর্যন্ত আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে সবার চেয়ে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র, সেখানে ইতোমধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে আর আক্রান্তের সংখ্যা ও ১৮ লাখের বেশী। আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ২২ তম। বাংলাদেশেও আক্রান্তের সংখ্যা ৪৪৬০৮ জন, মৃত্যুবরণ করেছে ৬১০ জন।
ভয়ঙ্কর ছোঁয়াছে এই বৈশ্বিক মহামারী মোকাবিলায় কোন দেশেরই অভিজ্ঞতা না থাকলেও চীনের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে অধিকাংশ দেশই সংক্রমনরোধে লকডাউন ঘোষনা করে। সমস্ত পৃথিবী থমকে যায়, তবে পৃথিবী থেমে থাকলেও মহামারী কিন্তু থামেনি। এখন পর্যন্ত প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয় নাই, আবার সুনির্দিষ্ট ওষুধও বাজারে আসেনি, কবে নাগাদ প্রতিষেধক কিংবা ওষুধ বাজারে আসবে, সেটিও সুনির্দিষ্টভাবে বলা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু, মানুষের জীবনতো থেমে থাকেনা, বাঁচতে হলে তার খাবার খেতে হয়, পরনের জন্য কাপড় লাগে, থাকার জন্য বাসস্থান দরকার হয়, বিনোদনের দরকার হয়, নতুন শিশুও প্রতিদিন জন্মগ্রহণ করছে, ফলে, বিশ্বে উৎপাদন ব্যবস্থা ও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকতে পারে না। একারনেই বিশ্বব্যাপীই ধীরে ধীরে লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে, উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে, আবার সচল হচ্ছে পৃথিবীর চাকা। তাই, যতদিন ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হয় ততদিন এই মহামারীর সাথেই আমাদের সহাবস্থান করতে হবে, এটাই বর্তমান বাস্তবতা। পন্ডিতেরা এই পরিস্থিতির একটা যুতসই নাম ও দিয়েছেন, “New Normal”, যা বাংলায় মনে হয়, ‘নতুন বাস্তবতা/স্বাভাবিকতা’ বলা যায়। ডিম আগে না মুরগী আগে এই কুতর্কের মতই জীবন বড় না-কি জীবিকা বড়- সে বিতর্কে না গিয়ে বোধহয়, এটুকু বলা যায় যে জীবন এবং জীবিকা দুটোই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ফলে, নতুন স্বাস্তবতা মেনে নিয়েই আমাদের পুনরায় কাজে ফিরতে হচ্ছে।
‘নতুন বাস্তবতায়’ আপনি বাইরে যাচ্ছেন মানেই কিন্তু সংক্রমনের ঝুঁকি বাড়ছে। যেহেতু, আর ঘরে থাকার সুযোগ নাই, সেহেতু, সংক্রমন থেকে বাঁচার দায় আপনাকেই বহন করতে হবে। আপনি এখন ভালোভাবেই জানেন যে, এই ভাইরাস শুধুমাত্র চোখ, নাক এবং মুখের মাধ্যমেই আপনার শরীরে প্রবেশ করতে পারে এবং কেবলমাত্র আকান্ত মানুষটি থেকেই আপনার শরীরে ভাইরাসটি প্রবেশ করতে পারে। কাজেই, প্রতিরোধ আপনাকেই করতে হবে। প্রতিরোধের জন্য যা করতে হবে, তাহলো-
### বাইরে গেলেই যথাযথ ভাবে মাস্ক পরতে হবে;
### অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে;
### সম্ভব হলে গণপরিবহন কিংবা জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে;
### কোন কারনেই অপরিষ্কার হাত দিয়ে চোখ, মুখ কিংবা নাক স্পর্শ করা যাবে না;
### আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে;
### ভয়ানক ছোঁয়াছে বলেই আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, ফলে, রোগ মোকাবিলায় শারীরিক (Immunity boosting) এবং মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে;
### যদিও এই রোগের নির্ধারিত কোন চিকিৎসা নাই, কিন্তু বাংলাদেশে অধিকাংশ রোগীই (৮০% এর বেশী) তেমন কোন ওষুধ ছাড়াই সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। কাজেই, করোনায় আক্রান্ত হলে আতঙ্কিত না হয়ে রোগ মোকাবিলার কৌশল ভেবে নিন;
### যাচাই বাছাই ছাড়া সামাজিক মাধ্যমের নানা রকম পরামর্শ কিংবা চিকিৎসা পদ্ধতিতে বিশ্বাস না করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শ মেনে চলুন;
### সতর্ক থাকুন, নিজে সুস্থ থাকুন, অন্যকে সুস্থ রাখুন।
যেহেতু, ভাইরাসটি বিজ্ঞানীদের একেবারেই অচেনা নয় এবং অনেকগুলো দেশই ইতোমধ্যে, মানবদেহে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরীক্ষায় চলে গেছেন, সেহেতু, Covid-19 এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারে খুব বেশী দিন সময় লাগবে না। নিশ্চয়ই, একদিন প্রথমবার আপনি করোনা রোগের কথা শুনেছিলেন, তেমনি, কোন একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে শুনতে পাবেন যে, করোনার Vaccine বের হয়ে গেছে। যতদিন তা নয়, ততদিন, সতর্ক থাকুন, ধৈর্যের সাথে ‘নতুন স্বাভাবিকতার’ সাথে খাপ খাইয়ে চলুন। তবে, বিশ্বাস রাখুন,
“আমরা করবো জয় নিশ্চয়!”
লেখক : মোঃ মনিরুল ইসলাম,অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ডিএমপি এন্ড সিটিটিসি ইউনিট প্রধান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।