আপনার বাসার কাজের লোকের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন তো?
সময়ের কাছে কখনো কখনো আমরা বড় অসহায় হয়ে পড়ি। নাগরিক জীবনের বাস্তবতার জাঁতাকলে পারিবারিক জীবনের চিরাচরিত রূপটি হয়তো সবসময় ধরে রাখা সম্ভব হয়ে উঠে না আমাদের। আর তখনই আসে ছন্দপতন।
একজন কর্মজীবী মা’য়ের কথা বলছি। তিনি ডাঃ বিচিত্রা রানী। পেশায় একজন ডাক্তার। কর্মরত আছেন ঢাকর একটি সরকারি হাসপাতালে। তাঁর স্বামীও একজন চাকরিজীবী। দুই সন্তানের জননী ডাঃ বিচিত্রা রানী। স্বামী সন্তানদের নিয়ে পুরান ঢাকার নাজিরা বাজারের একটি বাসায় থাকেন। তাঁর দুই সন্তানের মধ্যে একজন এখনো দুগ্ধপোষ্য শিশু। স্বামী ও নিজে কর্মজীবী হওয়ায় সন্তানদের দেখভাল করার জন্য খুবই দুশ্চিন্তায় দিন কাটে বিচিত্রা দম্পতির। একসময় অনিশ্চিত হয়ে পরে তাঁর চাকুরী চালিয়ে যাওয়া। এমন কোন নিকট আত্মীয় নেই যে তাঁর বাসায় এনে রাখবেন। তাই বাধ্য হয়ে সন্তানদের দেখভালের জন্য হন্যে হয়ে কাজের বুয়ার সন্ধানে নামেন।
২৯ আগস্ট, ২০১৯ খ্রি., সোমবার সকাল। মাথায় রাজ্যের দুশ্চিন্তা নিয়ে হাসপাতালে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছিলেন। ঠিক তখনই কলিং বেল বেজে ওঠে। গিয়ে দরজা খুলেন। দরজার ওপাশে একজন মহিলা আর একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে। তাদের জিজ্ঞেস করতেই তারা পরিচয় দিলেন একজন কোহিনুর আর একজন আমেনা। বিচিত্রার এক পরিচিতের কাছ থেকে কাজের লোক প্রয়োজন জানতে পেরে তারা এসেছে। আসলে কোহিনুর একজন দালাল, সে টাকার বিনিময়ে মানুষের বাসায় বুয়া সাপ্লাই দেয়। আজ সে আমেনাকে নিয়ে এসেছে। কোন কিছু না ভেবে, কোন বিচার বিশ্নেষণ না করেই আমেনাকে কাজের জন্য বাসায় রেখে দেন বিচিত্রা। তাঁর মাথা থেকে যেন রাজ্যের চিন্তা নেমে যায়।
প্রথম দিনই বিচিত্রা তার দুই সন্তানকে অচেনা অজানা আমেনার কাছে রেখে বাসায় তালা দিয়ে নিজের চাকুরীর জন্য ছুটে যান হাসপাতালে। একবারের জন্যও তার মাথায় আসেনি কি ঘটতে পারে অথবা ঘটবে। সারাদিন রোগী দেখতে দেখতে আর কাজের ব্যস্ততায় কখন যে সময় চলে গেছে টেরও পাননি তিনি। এমনকি ফোন করে যে বাসায় একবার খবর নিবেন সেই কথাটাও ভুলে গিয়েছিলেন। হাসপাতালের কাজ শেষ করে বিকেলে যখন বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হন তখন মনে পড়ল আমেনার কাছে রেখে আসা সন্তানদের কথা। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে দরজায় পৌঁছতেই দেখেন দরজার লক ভাংগা। বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে তাঁর।
ভিতরে ঢুকতেই দেখেন তার শিশু সন্তান দুটো পড়ে আছে মেঝের উপড়ে। চিতকার করে কাঁদছে তারা। কিন্তু দেখার কেউ নেই সেখানে। শিশু দুটোকে বুকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। চিৎকার করে ডাকতে থাকেন আমেনা আমেনা বলে। কোন সাড়া শব্দ নেই। বিচিত্রা ছুটে যান তার শোরাব ঘরের দিকে। ঘরে ঢুকতেই তার চোখ যেন ছানাবড়া। ঘরের সবকিছু ছড়ানো ছিটানো, আলমারি ভাংগা, লকার ভাংগা। লকারের মধ্যে রাখা নগদ টাকাসহ সোনার গহণা সব উধাও। বিচিত্রার পুরো ব্যাপারটা বুঝে নিতে আর সময় লাগলো না। সে তার স্বামীকে ফোন করে সব ঘটনা জানালেন। তাঁর স্বামী দ্রæত বাসায় ফিরে এসে কোন উপায়ান্তুর না দেখে তাঁকে সাথে নিয়ে চলে যান থানায় ।
বংশাল থানায় গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলেন ডিউটি অফিসারের কাছে এবং এর প্রেক্ষিতে বংশাল থানায় একটি নিয়মিত মামলা রুজু করেন। বিপত্তি ঘটে তখন, যখন কোহিনুর আর আমেনা সম্পর্কে তিনি কোন তথ্য দিতে পারেন না। কারণ তিনিতো কোহিনুর বা আমেনার কোন ছবি, ন্যাশনাল আইডি কার্ড বা কোন ঠিকানাই রাখেননি। এমনকি তাদের সম্পর্কে কোনো প্রকার যাচাই-বাছাইও করেননি তিনি।
মামলাটি এক পর্যায়ে থানা থেকে ডিবিতে হস্তানন্তর করা হয়। ডিবির লালবাগ বিভাগের কোতোয়ালি জোনাল টিম নানা তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে জোড়ালো তদন্ত চালিয়ে কিছু দিনের মধ্যেই দালাল কোহিনুরকে গ্রেফতার করে। কিন্তু কোহিনুরকে জিজ্ঞাসাবাদে আমেনা সম্পর্কে কোন তথ্য পেলো না গোয়েন্দারা। কোহিনুর জানায় আমেনার ঠিকানা সেও জানে না। কিন্তু গোয়েন্দারা হাল ছাড়ল না। ছোট ছোট তথ্য সংগ্রহ করে তারা তদন্ত কাজ অব্যাহত রাখে। ফলে দীর্ঘ সময় পর গত ১১ জুলাই ২০২০খ্রি. কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে আমেনাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় ডিবি পুলিশ।
আমেনার স্বীকারোক্তি মোতাবেক ঢাকার তাতিবাজার “মেসার্স ফোর স্টার জুয়েলার্স” এ অভিযান চালিয়ে জুয়েলার্স এর মালিক মোঃ আবুল হাসেম কে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার কাছে ১,২৮,০০০০/-(এক লক্ষ আটাশ হাজার) টাকার বিনিময়ে স্বর্ণগুলো বিক্রি করেছিল মর্মে জানায় আমেনা। দীর্ঘ এক বছর আগের ক্রয়কৃত চোরাই স্বর্ণ ইতোমধ্যে গলিয়ে চোরাই বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে হাসেম। জানা যায় আমেনা একজন পেশাদার চোর। এর আগেও সে একই রকম ভাবে বিভিন্ন বাসায় কাজের বুয়া সেজে চুরি করেছে। তাকে আদালতে সোপর্দ করা হলে সে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। তার অন্যান্য চুরি সম্পর্কে আরো তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।
বিঃ দ্রঃ বাসা-বাড়ি কিংবা কোন প্রতিষ্ঠানে যেকোনো প্রয়োজনে কাউকে নিয়োগ দেয়ার পূর্বে অবশ্যই তাদের পূর্ণাঙ্গ নাম, ঠিকানাসহ পরিচয় নিশ্চিত হয়ে এবং ছবি, ভোটার আইডি বা জন্ম-নিবন্ধনের কপি রেখে নিয়োগ দিবেন।