পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পুলিশকে অবশ্যই হতে হবে সংবেদনশীল, মানবিক ও মানবদরদি। তা ছাড়া যে কোনো ধরনের অপরাধ মোকাবিলা করার জন্য রাষ্ট্র, সংবিধান এবং দেশের মৌলিক আইন পুলিশকে ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে। এ কারণে পুলিশ বাহিনীর প্রতি আমার আবেদন- নিষ্ঠুরতা ও শারীরিক ক্ষমতার পরিবর্তে আইনি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। তিনি বলেন, পুলিশের দুই লাখ সদস্যের মধ্যে এক লাখ ৩৯ হাজার কনস্টেবল। যারা প্রতিমুহূর্তে দেশের আনাচে-কানাচে, শহরে-গ্রামে-বন্দরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিনে-রাতে সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টা প্যাট্রোল ডিউটি করেন। এরাই হচ্ছে পুলিশের প্রথম কনট্রাক্ট পয়েন্ট। আমাদের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য কনস্টেবল। তার আচার-আচরণ, শিক্ষা-দীক্ষা ও পেশাগত দক্ষতা, নৈতিকতা, বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই আমাদের দেশের পুলিশ বাহিনীর সার্বিক কর্মকাণ্ডকে জনগণের কাছে প্রতিফলিত করে। এ কারণে থানার পাশাপাশি এই যে বিপুলসংখ্যক সদস্য, যারা প্রতিনিয়ত লাখ লাখ মানুষের মুখোমুখি হচ্ছেন, তাদের চিন্তা-চেতনা, আচরণ ও নৈতিকতায় পরিবর্তন আনা সবচেয়ে জরুরি। পুলিশ সদর দপ্তরের নিজ কার্যালয়ে সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে পুলিশপ্রধান ড. বেনজীর আহমেদ এসব কথা বলেন।
সমকাল : করোনাকালে মানবিক পুলিশের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। পুলিশ কি নিজ থেকে বদলে গেছে, নাকি বদলে যাওয়ার চাপ ছিল?
আইজিপি : চাপ দিয়ে পরিবর্তন আনা যায় না। আর চাপ দিয়ে কোনো কারণে পরিবর্তন ঘটানো হলে তা খুব ক্ষণস্থায়ী হয়। সেটার প্রভাব সর্বজনীনও হয় না। সেটা কখনও আন্তরিকও হয় না। বাংলাদেশ পুলিশের জন্ম ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এ দেশের মানুষের নাড়ির সঙ্গে পুলিশের এক ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। পুলিশ সদস্যরা জনগণের অংশ থেকে উঠে আসা। তাদের প্রত্যেকের শরীরে কাদামাটির গন্ধ আছে। যেহেতু পুলিশ জনগণের অংশ, তাদের মধ্যে বসবাস করে, এ জন্য মানুষের আর্তি বা প্রয়োজন তারা ভালো বুঝতে পারে। ১৯৭১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই পুলিশ বাহিনী বুঝতে পারে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ সমাসন্ন। দেশের অনেক স্থানে মহকুমা বা জেলা পুলিশের অস্ত্রাগার ২৬ মার্চের আগেই খুলে দেওয়া হয়। ছাত্র, জনতা ও মুক্তিকামী মানুষকে বিভিন্ন পুলিশ লাইনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হয়। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তাদের কাছে বিশাল দিকনির্দেশনা ছিল। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পুলিশকে অবশ্যই সংবেদনশীল মানবিক এবং মানবদরদি হতে হবে। আধুনিক সমাজে যে জনআকাঙ্ক্ষা রয়েছে, তার সঙ্গে পুলিশের শারীরিক ক্ষমতার প্রয়োগের বিষয়টি যায় না। আমাদের অবশ্যই সংবেদনশীল ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন পুলিশি ব্যবস্থা বলবৎ করতে হবে। এটি আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধ।
সমকাল : আপনি পাঁচটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগোচ্ছেন- দুর্নীতি রোধ, মাদকমুক্তি, পুলিশের নিষ্ঠুরতা বন্ধ, বিট পুলিশিং ও পুলিশ সদস্যদের কল্যাণ। সফল হলে পরবর্তী লক্ষ্য কী?
আইজিপি : এটি খেলাধুলার বেঞ্চ মার্কের মতো। যখন খেলাধুলার ক্ষেত্রে কোনো রেকর্ড ভাঙি, তখন আমরা রেকর্ডটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাই। আমরা যখন মনে করব, দেশে মাদকের অভিশাপ থাকবে না, পুলিশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি থাকবে না, দুর্নীতির বিরুদ্ধে পুলিশ বাহিনী প্রধানমন্ত্রীর নীতি-কৌশল অনুযায়ী জিহাদে লিপ্ত থাকবে, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন দক্ষ, পেশাদার পুলিশ বাহিনী এ দেশে দায়িত্ব পালন করবে, যে বাহিনীর সব সদস্যের কল্যাণ রাষ্ট্র ও সংগঠন নিশ্চিত করবে- এ রকম একটা সময়ের পর আমরা অবশ্যই ২০৪১ সালে প্রধানমন্ত্রী যে আধুনিক এবং ধনী দেশের রূপকল্প আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন, সেই সমাজের উপযোগী একটি পুলিশ বাহিনী গঠনের পরবর্তী ধাপ অতিক্রম করা হবে আমাদের আরেকটি লক্ষ্য।
সমকাল : থানা হলো পুলিশি সেবার দর্পণ। ওসিদের কাছে কেউ ঘুষ চাইলেও আপনাকে সরাসরি জানাতে বলেছেন। সারাদেশের ওসিদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের পর ঘুষের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ আপনি সরাসরি পেয়েছেন?
আইজিপি : আমি এরই মধ্যে বলেছি, আমাদের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় যেসব দুর্নীতি থাকবে, সেখানে সরকারের নির্দেশে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আমি সম্পূর্ণ একমত, বাংলাদেশের থানাগুলো হলো পুলিশ বাহিনীর মুখচ্ছবি। যদি আমরা গণমুখী, জনকল্যাণকর থানা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলেই আধুনিক পুলিশি ব্যবস্থার সুফল জনগণ পেতে পারে। এ কারণে আমার নীতি-কৌশলের ক্ষেত্রে থানার সেবার মান বদলানো অন্যতম। শুধু থানা নয়, আমি আরও সামনে যেতে চাই। সবচেয়ে বেশি সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হয় আমাদের বাহিনীর অধস্তন সদস্য কনস্টেবলদের সঙ্গে। আসলেই তাদের সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে লাখ লাখ মানুষের দেখা হয়। এরাই হচ্ছে পুলিশের প্রথম কনট্রাক্ট পয়েন্ট। এ কারণে তাদের চিন্তা-চেতনা, আচরণ ও নৈতিকতায় পরিবর্তন আনা সবচেয়ে জরুরি। যদি আমরা থানার পাশাপাশি এটা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে এ দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর যে সোনার বাংলা; তার উপযোগী পুলিশ বাহিনী উপহার দেওয়া সম্ভব।
সমকাল : পুলিশের অনেক পদে ঘুরেফিরে একই মুখ দেখা যায়। পুলিশে পদায়নে কী ধরনের নীতি মানা হয়?
আইজিপি : কোন পদে কে দায়িত্ব পালন করবেন, এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। এটা সরকারের প্রয়োজনের ওপর নির্ভর করে। এখানে দক্ষতা-অদক্ষতার বিষয় রয়েছে। যিনি যোগ্য, তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যাবেন- এটাই স্বাভাবিক। এভাবেই মূলত দক্ষতা, যোগ্যতা ও শিক্ষার মূল্যায়ন করা হয়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে যাতে সবচেয়ে যোগ্যতম লোকটি দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেটা নিশ্চিত হওয়াই লক্ষ্য। তবে এটাও ঠিক, সরকারের বদলি ও পদায়ন-সংক্রান্ত নীতি রয়েছে। পুলিশপ্রধান হিসেবে সরকারের বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতি-সংক্রান্ত যে নীতি রয়েছে, সেগুলো অবশ্যই প্রতিপালন নিশ্চিত করব।
সমকাল : পুলিশ না হলে কী হতেন?
আইজিপি : আমি এভাবে ভাবি না। আমরা অনেক কিছু প্রথম থেকে শুরু করতে পারি না। যাপিত জীবনকে নতুনভাবে যাপন করা যায় না। নিয়তি, পছন্দ, সময় ও সুযোগ সব মিলিয়ে এখানে এসেছি। মূল বিষয় হলো, আমি যেখানে রয়েছি, সেখানে আমার পেশাগত ও নৈতিক দায়িত্বটি সততা ও সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সঙ্গে এবং কর্তব্যকে ভালোবেসে জনগণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। এটা হলো সন্তুষ্টির জায়গা। এটাই রাষ্ট্রের কর্মচারীকে সাফল্য এনে দিতে পারে।
সমকাল : ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
আইজিপি : আইনটি কীভাবে প্রয়োগ করা হবে, সেটা আইনে বলে দেওয়া আছে। আইনটির যথাযথ প্রয়োগ আমরা নিশ্চিত করতে চাই। যাতে অপপ্রয়োগ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রয়েছে। আইনের যে উদ্দেশ্য রয়েছে, যাতে সেটি শুধু সাধিত হয় সেই চেষ্টা আমাদের নিরন্তর।
সমকাল : যখন অবসরে যাবেন, পুলিশকে কোন জায়গায় দেখতে চান?
আইজিপি : অবসরে গেলে কেমন পুলিশ দেখতে চাই, গত ৩২ বছর নিজে সেই পুলিশ হওয়ার চেষ্টা করেছি। আবার আমার সহকর্মীদের সেই পথে মোটিভেট করেছি।
সমকাল : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আইজিপি : আপনাকেও ধন্যবাদ।