চরম নিষ্ঠুরতা!!
(নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা বহুলাংশে দেখা যায়)
অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ‘সনেট’ (ছদ্মনাম)। গরীব ঘরের সন্তান। অতি বাল্যকালে বাবাকে হারিয়েছেন। মা অনেক কষ্টে মেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। সনেট লেখাপড়ার পাশাপাশি ছোটখাটো একটা চাকরিও করেন। প্রতিমাসে বেশকিছু টাকাও আয় করেন। অভাবের সংসারে টানাটানিতে সংসার চলছে। মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে মা তাকে আরেকটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বিয়ে দেন। হয়তো ভেবেছিলেন মেয়ের সুখের সংসার হবে, তাই বিয়ের সময় সাধ্যমত উপহার সামগ্রী, নগদ অর্থ দিয়েছেন। কিন্তু সুখ পাখির ঠিকানা বহুদূর।
বিয়ের অল্পদিন পরেই শ্বশুরবাড়ির লোকজন টাকা পয়সার জন্য বিভিন্ন ভাবে চাপ দিতে থাকেন। সনেট সুখের কথা চিন্তা করে তার মাসিক আয়ের এর পুরো টাকা শাশুড়ি আর জামাইয়ের হাতে তুলে দেন। তাতেও তাদের কোনো ভাবেই মন ভরে না।
অনেক কষ্ট করে কয়েকবার মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা পয়সা এনে দিয়েছেন। অতি লোভী স্বামী সজল এবং তার লোভী মা পারভিন ,শশুর বাবর আলী তাদের কূটচাল চালাতে থাকে প্রতিদিন সহজ সরল মেয়েটির প্রতি। বিয়ের মাত্র তিন মাস পরেই তারা অভিযোগ তোলে এই মেয়ের কখনো বাচ্চাকাচ্চা হবে না। এমন অভিযোগ এবং বারবার যৌতুকের প্রতি চাপ সৃষ্টির ফলে মেয়েটি সহ্য করতে না পেরে তার মায়ের নিকট চলে আসে। কিছুদিন পর শশুর পক্ষ আরো কিছু পাবার লোভে মেয়েকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসে। উদ্দেশ্য মেয়েটি মাসিক যে কয় টাকা আয় করে তা হাতিয়ে নেওয়া। এমতাবস্তায় মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হলে শশুর পক্ষের লোকজন তারা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। স্থানীয় একটি হাসপাতালে আলট্রাসনোগ্রাফি করে যখন নিশ্চিত হয় সত্যি সত্যি মেয়েটির সন্তানসম্ভবা তখন তারা নতুন করে কূটচাল শুরু করে।
হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর তার নিষ্ঠুর শাশুড়ি, শশুর এবং জামাই মিলে জোর করে ডাকে গর্ভপাত ঘটানোর জন্য ওষুধ সেবন করায়। এবং তারা অপেক্ষা করতে থাকে কখন গর্ভপাত হবে।
ওষুধ সেবন করার পর গর্ভপাত না হলে কয়েকদিন পরে আবার জোর করে কয়েক ডোজ ঔষধ সেবন করায়। এতে মেয়েটি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তারা ভয় পেয়ে একটা রিকশাভ্যানে করে অমানবিকভাবে মেয়েটিকে তার মায়ের বাসার সামনে ফেলে রেখে চলে যায়।
দুঃখী মা মেয়েটিকে পুনরায় সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে। সনেট পুনরায় তার কর্মস্থলে যোগদান করে। ওইদিকে এতকিছুর পরও মেয়েটির অকাল গর্ভপাত না হওয়ায় শশুর পক্ষ খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে।
শাশুড়ি এবং জামাই মিলে মেয়েটির কর্মস্থলে গিয়ে তাকে হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চায় এবং এত ওষুধ সেবনের পরেও যেহেতু এ বাচ্চা নষ্ট হয়নি তারা এ বাচ্চা নষ্ট করবেনা স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্ম দিতে পারবে এবং আর কোনো নির্যাতন করবেনা আশ্বস্ত করে মেয়েটিকে পুনরায় তাদের বাড়িতে নিয়ে আসে।
সেখানে আসার পর নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করে কিভাবে এই বাচ্চা নষ্ট করা যায়। সনেট কে বুঝানো হয় যেহেতু সে এতগুলো ওষুধ সেবন করেছে বাচ্চাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হলো কিনা সেটি দেখার জন্য তার পুনরায় মেদিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চায় তারা। সনেট কে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় তার ভালোর জন্যই পরীক্ষা করা দরকার।
সনেটের স্বামী তাকে নিয়ে ডাক্তার দেখানোর জন্য বাসা থেকে বের হয়। একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাবার পর সনেট দেখতে পায় তার দজ্জাল শাশুড়ি এবং শ্বশুর আগে থেকেই সেই ক্লিনিকে অপেক্ষা করছে। শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখে সনেটের সন্দেহ হলে সে সেখান থেকে ফিরে আসতে চায় কিন্তু এতগুলো হায়নার কাছ থেকে লিকলিকে হালকা-পাতলা গড়নের পর্দানশীল মেয়েটি বেরিয়ে আসা তো এত সহজ নয়।
তাকে জোর করে নেওয়া হয় ক্লিনিকের ভেতরের কক্ষে।
সনেট সেখানে আরো দুজন নার্স মহিলাকে দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে তাদের সহযোগিতা প্রার্থনা করে। সনেট কোনভাবেই এ সন্তান নষ্ট করতে চায়না। অনেক চিৎকার কান্নাকাটি কোন কিছুই চার দেয়ালের বাইরে বেরিয়ে আসার সুযোগ নেই।
স্বামী শাশুড়ি শ্বশুর এর সাথে আরো নতুন দুই হায়না যোগ দেয়। তথাপিও সনেট সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ভেতরের গোপন পক্ষ থেকে একবার বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা দুর্বল শরীরের মেয়েটির পক্ষে কোনভাবেই পাঁচটি দস্যুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। স্বামী শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই মিলে তার হাত পা গলা চেপে ধরে জোরপূর্বক তার গর্ভপাত ঘটিয়েছে।
পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন গর্ভপাত গুটিয়ে বউকে নিয়ে তারা বাড়ি ফিরেছে!! মোটেই তা হয়নি। অত্যন্ত অমানবিকভাবে একটি ভ্যানে করে মেয়েটিকে তার মায়ের বাসার সামনে অনেকটা অচেতন অবস্থায় ফেলে রেখে চলে আসে।
আমাদের মেয়েরা মায়েরা সামান্য সুখের আশায় অনেক কিছু সহ্য করে। কিন্তু সহ্য সীমা কতটুকু থাকে সেটা আশ্চর্য বোধক!!
এমন হৃদয়বিদারক বিষয়টি আমি জানতে পেরে হতবাক হয়ে যাই। প্রতিদিন কত অজানা অপ্রকাশিত ঘটনা আমাদের পুলিশের ভান্ডারে জমা হয় তার ইয়ত্তা নেই। আমি বলব খুব সামান্যই প্রকাশ পায়। নিরবে নিভৃতে কাজ করে যায় পুলিশ। অনেক সময় ভাবি এমন অপ্রকাশিত কথাগুলো নিয়ে লিখব। কিন্তু লেখার সময় হলেও পড়ার সময় খুঁজে বের করা লোকের সংখ্যা খুবই কম বর্তমানে।
তাৎক্ষণিকভাবে থানায় মামলা রেকর্ড করা হলো। অতি তড়িৎ ভাবে পুলিশ মামলার সকল আসামিদের কে গ্রেপ্তার করল। এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় সনেটের শাশুড়ি অনুশোচনা হীন শারীরিকভাবে শক্তপোক্ত নিষ্ঠুর চাহনি অতি লোভী চোখ মনে করিয়ে দেয় আমাদের মেয়েদের অসুখের জন্য বহুলাংশে হয়তো মেয়েরাই দায়ী।
পুলিশ সুপারের কার্যালয় আমার অফিসে পৌঁছে অসহায় মেয়েটির কান্না ঝরা বর্ণনা সহ্য করা খুবই কঠিন। কিন্তু কি হবে প্রতিদিন এমন অনেক ঘটনা আমাদের শুনতে হয় এবং আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি সাধারণ মানুষের পাশে থাকার জন্য।
আমি মহান আল্লাহর কাছে অনেক বেশি কৃতজ্ঞ মানুষের পাশে থেকে কাজ করার মত পুলিশি পেশায় নিযুক্ত রয়েছে যা অন্য কোন পেশায় থাকলে হয়তো সম্ভব হতো না।
আইনের মারপ্যাঁচে সনেট রা যাতে
ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত না হয় । কারণ এই সনেটদের পক্ষে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যা অনেক কম।
এরকম সনেটদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ পুলিশ সর্বদা পাশে রয়েছে। পুলিশকে তথ্য দিন সেবা নিন।
ধন্যবাদ জানাচ্ছি অতি দ্রুত অভিযান পরিচালনা করে সকল আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য আমার প্রিয় সহকর্মী সকল পুলিশ সদস্যদের প্রতি।
মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান পিপিএম (বার )
পুলিশ সুপার সাতক্ষীরা।
০২/০৯/২০২১