মানুষরে পাশে থেকে বিপদে সাহায্য করবেন বলে পুলিশ ক্যাডারে যোগদানের লক্ষ্য নিয়ে নবম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। মেধা তালিকায় ছিলেন একেবারে প্রথম দিকে। নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রশাসন ক্যাডারে। দশম বিসিএস-এ আবারও অংশগ্রহণ করলেন। এবার মেধা তালিকায় হলেন প্রথম। এবারও নির্বাচিত হলেন প্রশাসন ক্যাডারে-কিন্তু মানুষকে পাশে থেকে সরাসরি মানুষের সেবা করার সুযোগটা পুলিশ ক্যাডারে বেশি বলে তাঁর ও তাঁর বাবা মায়ের আগ্রহ বেশি ছিল পুলিশ ক্যাডারেই। তাই তৃতীয়বারও দিলেন বিসিএস পরীক্ষা। ১২তম বিসিএস-এ নির্বাচিত হলেন কাঙিক্ষত সেই পুলিশ ক্যাডারে।

দুইবার মেধা তালিকায় থাকার পরও তৃতীয়বার বিসিএস দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন জানতে চাইলে মৃদু হাসেন তিনি। বলেন, সেই শৈশব থেকেই মানুষের বিপদে পাশে থাকার দীক্ষা পেয়ে বড় হয়েছি। বিএসএস’র ক্যাডারগুলোর মধ্যে একমাত্র পুলিশ ক্যাডারে বিপদগ্রন্ত মানুষগুলোকে সেবা দেওয়ার সুযোগটা বেশি-তাই আমি পুলিশ হতে চেয়েছিলাম এবং হয়েছি।

প্রিয় পাঠক, শুধুমাত্র মানুষের পাশে থাকবেন বলে;বিপদে সাহায্য করবেন বলে-যে মানুষটি বিসিএস’র মতো কঠিন ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার লড়াইয়ে তিনবার মুখোমুখি হয়েছেন এবং সফলতার সাথে উত্তীর্ণও হয়েছেন তিনি হলেন বাংলাদেশ পুলিশের মেধাবী কর্মকর্তা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) খন্দকার গোলাম ফারুক বিপিএম (বার), পিপিএম। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

মন-মননে অত্যন্ত উদার,মেধাবী এই মানুষটি টাঙ্গাইলের ভুঞাপুর থানার ঘাটান্দি গ্রামে সম্ভ্রান্ত এবং শিক্ষানুরাগী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৪ সালের ১ অক্টোবর। বাবা মৃত খন্দকার হায়দার আলী এবং মা ফাতেমা বেগম। স্ত্রী শারমীন আক্তার খানের সাথে ঘাটছড়া বাঁধেন ১৯৯৩ সালে।

খন্দকার গোলাম ফারুকের দাদা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জনের গৌরবধারী একজন শিক্ষানুরাগী। শিক্ষার অনুপ্রেরণাটা তাই পরিবার থেকেই পেয়েছিলেন তিনি।

আলাপচারিতায় অকপটে বলেন, বাবা গ্রামেই থাকতেন। কৃষিকাজ দেখাশুনা করতেন। বাবার স্বপ্ন ছিল তাঁর ছেলেকে সুশিক্ষিত করে সৎ মানুষ হিসাবে গড়ে তুলবেন। বাবার সে স্বপ্ন পূরণের জন্য আমি আজও কাজ করে যাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, শৈশবে অভাব না থাকলেও স্বাচ্ছন্দ্যের পুরোটা হয়তো ছিল না। ছিল না প্রাইভেট শিক্ষক রেখে লেখাপড়া করার সুযোগও। তবুও নিজের চেষ্টা এবং বাবা-মায়ের উৎসাহ ও দোয়াসকল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উর্ত্তীণ হয়েছি।

শৈশবের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ যখন হয়েছে তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম। যুদ্ধ কী তেমন করে বুঝিনি। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী বিধস্ত সময়ের দারিদ্রতার যুদ্ধ দেখেছি। দেখেছি গ্রামের হতদরিদ্র মানুষগুলোর বেঁচে থাকার লড়াই।

বাবা আমাকে প্রায়শ্চই বলতেন, বড় হয়ে হতদরিদ্র এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। বিপদে সাহায্য করতে হবে। বাবার সে আদেশ পালন করতে মানুষের সেবা করার জন্য আমি পুলিশ হয়েছি। বলেন ডিআইজি গোলাম ফারুক।

ভুঞাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বারই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করেন গোলাম ফারুক। এরপর ভুঞাপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালে এস.এস.সি সম্পন্ন করে ভুঞাপুর ইব্রাহিম খাঁ সরকারি কলেজ থেকে ১৯৮১ সালে এইচ.এস.সি সম্পন্ন করেন। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি সম্পন্ন করেন ১৯৮৮ সালে । পরে ২০০৭ সালে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি,ঢাকা থেকে সম্পন্ন করেন এম.এ।

চাকরি জীবনের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, চাকরির একদম শুরুর দিকে। তখন আমি এ.এস.পি প্রবেশনার হিসেবে কর্মরত। ভাঙা থানায় ইন্সপেকশন বাংলোয় থাকতাম। একদিন এক দরিদ্র বৃদ্ধ লোক আমার কাছে এসে কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘তাঁর বসতবাড়ি কিছু দূর্বৃত্ত দখল করে তাঁকে বের করে দিয়েছে।’ সাথে সাথে আমি অভিযোগ নি। কিছু ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দূর্বৃত্তদের গ্রেফতার করে বৃদ্ধকে তার বাড়ি বুঝিয়ে দেই।

এরপর দিন ভোরবেলা। বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমার বাসার সামনে বসে আছেন। সাথে নিয়ে এসেছেন নিজ গাছের খেজুরের রস আর গুড়। অশ্রুভেজা চোখে আমার জন্য দোয়া করে সেই বৃদ্ধ বললেন, জীবনে অনেক বড় হন বাবা। জানান ডিআইজি ফারুক। বলেন, সেই দিনটির ঘটনা আজও আমার কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সেদিন থেকে দীর্ঘ এই চাকরিজীবনে কাজ করেছি অসহায়, দরিদ্র মানুষের জন্য। আজ তাঁদেও দোয়ায় আমি এই অবস্থানে। যতদিন চাকরি করবো মানুষের জন্য আমরা দরজা সবসময় খোলা থাকবে।

ব্যক্তি জীবনে তিন কন্যা সন্তানের বাবা তিনি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধ্যয়নরত বড় মেয়ে ফাবলিহা খন্দকার’র জন্ম ১৯৯৬ সালের ২৪ মে। মেজো মেয়ে নাবলিহা খন্দকার’র জন্ম ২০০০ সালের ৯ অক্টোবর। সম্প্রতি এইচএসসি সম্পন্ন করেছেন। ছোট মেয়ে তাসনিয়াহ খন্দকার জন্মগ্রহণ করেন ২০০৬ সালের ১১ অক্টোবর। পড়েন ৮ম শ্রেণিতে।

১২ বিসিএস-এ উত্তীর্ণ হয়ে খন্দকার গোলাম ফারুক পুলিশ বিভাগে যোগ দেন ২০ জানুয়ারি ১৯৯১ সালে। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শেষে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এপিবিএন, বগুড়া তে। পরবর্তীতে সহকারী কমিশনার, সিএমপি, সহকারী পুলিশ সুপার, খাগড়াছড়ি (সার্কেল), সহকারী কমিশনার, ডিএমপিতে কর্মরত ছিলেন।

এরপর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলাতে। পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন ঠাকুরগাঁও, কিশোরগঞ্জ,ঝালকাঠি, জামালপুর, ময়মনসিংহ জেলায়। এছাড়া সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এপিবিএন, মুক্তগাছা, ময়মনসিংহ-এ। দায়িত্ব পালন করেছেন এআইজি, পুলিশ সদর দপ্তর, এসএস, সিটিএসবি তে। অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন ডিএমপি’র জয়েন্ট কমিশনার। দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে।

ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ডিএমপি ও ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন রংপুর রেঞ্জ-এ। ২০১৮ সালের ১৪ জুলাই থেকে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ পুলিশের চৌকস এই কর্মকর্তা।





০ মন্তব্য

আরও পোস্ট পড়ুন

মতামত দিন