সম্মানিত জেলাবাসী আমার শুভেচ্ছা নিন। সাতক্ষীরা জেলায় জেলা প্রশাসক হিসেবে আজকে আমার ২ বছর ছয় মাস পূর্ন হলো তথা ৩০ মাস জেলা প্রশাসক হিসেবে এ জেলায় আপনাদের সেবায় কাজ করছি । প্রথমে আপনাদের সকলকে কৃতজ্ঞতা জানাই এই ২.৫ বছরে কর্মকালে জেলা প্রশাসনের কর্মকান্ডে আপনাদের ক্রমাগত সহযোহিতার জন্য । আপনারা সকলেই অবগত আছেন ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর জেলা প্রশাসক হিসেবে এই জেলায় যোগদান করি। তারপরেই ছিল জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৮ সালের ৩০ডিসেম্বর যা অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে জেলার সকল সরকারী দপ্তরের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার পাশাপাশি জেলাবাসী হিসেবে আপনারা অকুন্ঠ সমর্থন দিয়েছিলেন যার ফলে একটি সুষ্ঠ,সুন্দর ও শান্তিপূর্ন নির্বাচন উপহার দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।
সম্মানিত জেলাবাসী ,এই ২.৫ বছরের কর্মকালে সাতক্ষীরা জেলাতে প্রথমে ফণি ,বুলবুল, ডেঙ্গু , করোনা এবং করোনার মধ্যে আম্ফান হানা দিয়েছিলো। করোনার ১ম ঢেউ স্থিমিত হয়ে আবার শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ঢেউ। বর্তমানে এটি এত ভয়াবহ আকার ধারন করেছে যে প্রতিদিনই বাংলাদেশে রেকর্ডসংখ্যক মানুষ মৃত্যবরণ করছে এবং আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসকের এই ২.৫ বছর কর্মকালকে সত্যিকার অর্থে চ্যলেঞ্জিং সময় বলা যায় এবং আমার কর্মকালের সবচেয়ে দুর্লভ অভিজ্ঞতা এ জেলায় অর্জন করেছি।

মানুষের ভালোবাসা কতটুকু পেয়েছি সে হিসাব কখনো করতে যাইনি বরং মানুষকে কতটা ভালোবাসতে পেরেছি ,মানুষের পাশে কতটা দাড়াতে পেরেছি, মানুষকে কতটুকু রাষ্ট্রীয় সেবা সহজভাবে দিতে পেরেছি, মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে কতটা শ্রম দিয়েছি, কতটা আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেছি, কোথাও কোন ঘাটতি ছিল কিনা এটাই বারবার ভেবেছি। আপনারা সকলেই অবগত আছেন যখন করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতর সুপার সাইক্লোন আম্ফান আঘাত হানে তখন অনেকেই দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো কিন্তু মহামারী করোনা ডেংগু ,প্রলয়ঙ্কারী আম্ফান ,বুলবুল,ফণিসহ প্রতিটি দুর্যোগ দুর্বিপাকে মাথা ঠান্ডা রেখে দৃঢ়তা নিয়ে অবিচলভাবে আপনাদের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছি। আপনারাও অনুরূপভাবে সাড়া দিয়েছেন প্রতিটি কর্মকান্ডে। আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া কখনোই সম্ভব হত না এই ২.৫ বছরের কর্মকাল অতিক্রম করা। আমি এই দিনে অত্যন্ত কৃতজ্ঞতা চিত্তে স্মরণ করছি সাতক্ষীরা জেলার ৪ জন মাননীয় জাতীয় সংসদ সদস্যবৃন্দকে ,জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মরহুম মুনসুর আহমেদ ,সাধারন সম্পাদক আলহাজ্ব মোঃ নজরুল ইসলামসহ সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে, সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাগনকে, গণমাধ্যম কর্মী , সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধি ,সর্বোপরি আমার সহকর্মীবৃন্দ, জেলা পর্যায়ের সকল কর্মকর্তাবৃন্দ এবং জেলার সর্বস্তরের অধিবাসীগন।

সম্মানিত জেলাবাসী , আমরা জানি যখনই কোন কাজে আপনি সফল হবেন তখন সেই কাজ কিছু মানুষের দ্বারা প্রশংশিত হবে যা কিছু মানুষকে ঈর্ষান্বিতও করবে। সফলতাকে অন্যভাবে নিজের এক ধরনের শত্রু হিসেবে ধরা যায়। এভাবে বলা যেতে পারে যে ,কারোসাথে কোন ধরনের বাগ বিতন্ডায় না জড়িয়ে, কারো কোন স্বার্থ হানি না করেও আপনি শত্রু হয়ে যেতে পারেন যদি আপনি লক্ষ্যে অবিচল থেকে সফল হন। আপনার একটি সফল উদ্যোগ কখনো কখনো আপনার শত্রু হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। এগুলোকে মাথায় রেখেই কাজ করতে হয়। যখন লক্ষ্য থাকে একটি নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলা ,সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বিকাশের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নতুন প্রজন্মের কাছে পোছে দেওয়া তখন অপছন্দের অনেক কিছুকে সহ্য করে যেতে হয়। সব সময় সচেষ্ট থেকেছি শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়াক্ষেত্রের একটি নব ধারার সূচনা করতে যার ফলে আগামী দিনের কান্ডারীদেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা যায়। তাদের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ছিলো আমার মনোযোগের কেন্দ্র বিন্দুতে। যে কাজটি জেলা প্রশাসন মুজিবর্ষ উপলক্ষে শুরু করেছে। প্রথম ব্যাচের ৬০ জন যুব তরুণ সফলতার সাথে শেষ করেছেন। কয়েকজন উপার্জন করছে। সাতক্ষীরা জেলায় বিগত ২.৫ বছরে আপনারা দেখেছেন ৪টি বইমেলা,নাট্য উৎসব ,আবৃত্তি উৎসব, কুইজ প্রতিযোগিতা ,গল্প বলা প্রতিযোগিতা , বিতর্ক প্রতিযোগিতা এবং মুজিববর্ষ আইটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। তরুণদের জন্য মুজিববর্ষ তারুণ্যের ভাবনা শীর্ষক অনুষ্ঠান। করোনার ভয়াবহতার মধ্যে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড চালু রাখা সম্ভব হয়েছিলো আপনাদের ঐকান্তিক সহযোগিতা এবং সক্রিয় অংশগ্রহনের জন্য। এর মাধ্যমে শিল্পীদের পাশে করোনা সংকট কালে সামান্য হলেও সহযোগিতার হাত বাড়াতে পেরেছিলো জেলা প্রশাসন ।

আমার কর্মকালে জেলা প্রশাসনের প্রাত্যহিক কাজের বাইরে অন্যতম জনবান্ধব কাজ গণশুনানি। আপনারা জানেন এই গণশুনানির মাধ্যমে কিভাবে জেলাবাসী উপকৃত হয়েছে। পরিসংখ্যান মতে শুধুমাত্র গণশুনানির মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে এই জেলার মানুষের জন্য ১ কোটির অধিক টাকার চেক এসেছে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সহ নানা মানবিক প্রয়োজনে। জেলা প্রশাসকের ঐচ্ছিক তহবিল,সমাজসেবা তহবিল এবং স্থানীয়ভাবে আহরিত রাজস্ব তহবিল হতে বিভিন্নভাবে মানুষের কল্যানের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। বেকারদের জন্য স্বল্প আয়ের কর্মসংস্হান সৃষ্টি করা, অস্বচ্ছল শীক্ষার্থীদের বই ও শিক্ষা উপকরন দেওয়া , বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ,বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করা ,চিকিৎসার জন্য অর্থ সহায়তা করা বছরব্যপী পরিচালিত হয়েছে। জেলা প্রশাসন এই ২.৫ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় যে ভূমিকা পালন করেছে তা সম্ভব হয়েছে আপনাদের সকলের সমর্থন সহযোগিতার জন্য। । করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন এবং উপজেলা প্রশাসনের প্রতিটি কর্মকর্তা সকল বিভাগের সাথে সুসমন্বয় করে নিজেদের জীবন বাজি রেখে সর্বোচ্চ উজাড় করে কাজ করেছে । আমি সেই টীমের একজন গর্বিত সদস্য যিনি এই জেলা প্রশাসনে ২.৫ বছর কার্যকাল অতিক্রম করেছি।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে জেলাব্যপী বিশাল কর্মসূচি গ্রহন করা হয়েছিল। সকল কর্মসূচি নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তোলার লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পূর্ণ থাকলেও মহামারী করোনা প্যান্ডেমিকের সংক্রমণ দেখা যাওয়ায় সকল প্রোগ্রাম স্থগিত করা হয় । তারপরেও সাতক্ষীরা শহরের শহিদ আব্দুর রাজ্জাক পার্ক , পৌর দিঘি এবং আশেপাশের এলাকা নান্দনিকভাবে সুসজ্জিত করা হয়েছিল। মুজিববর্ষ এবং মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ১৭ মার্চ হতে ২৬ মার্চ জেলা প্রশাসন যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল সেটি ছিল আমার কর্মজীবনের সেরা আয়োজন। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা নুতন প্রজন্মের কাছে এই বার্তাটাই পৌছে দিতে চেয়েছি যে যারা আমাদের জন্য এই দেশ এনে দিয়েছে সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা সম্মান জানাবো এবং নতুন প্রজন্ম এটি শিখবে যে কিভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং গুরুজনদের প্রতি সম্মান জানাতে হয়।
১০ দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানমালা বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তরুণদের প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছিলো। মুজিববর্ষ ডিসি কাপ ফুটবল টুর্ণামেন্ট, জাতীয় পর্যায়ের ২০টি প্রকাশনীর অংশগ্রহণে ১০দিনব্যপী মুজিববর্ষ বঙ্গবন্ধু বইমেলা্ কুইজ প্রতিযোগিতা , বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে যা আমার কর্মজীবনের সবচেয়ে নান্দনিক ,বর্ণিল,এবং উৎসবমূখর অনুষ্ঠান । ১৭ মার্চে শিশু কিশোরদের আয়োজনে যে অনুষ্ঠান কারা হয়েছিল তা ছিল স্মরণকালের সবচেয়ে গোছানো এবং বর্ণাঢ্য। ১০০ পাউন্ডের কেক কেটে ,১০০টি আতশবাজি প্রজ্জ্বলিত করে শিশু কিশোরসহ সাতক্ষীরা জেলার আপামর জনগন জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করে। এই আয়োজনের সাথে যুক্ত সকল কর্মকর্তা ,শিল্পী ও কলাকুশলীদের আমি কৃতজ্ঞতা জানাই ।

সম্মানিত জেলাবাসী , আপনারা জানেন যে সাতক্ষীরা শহরের প্রাণকেন্দ্র দিয়ে প্রবাহিত প্রাণসায়র খালের বড় একটি অংশ দীর্ঘদিন অবৈধ দখলদারদের দখলে ছিল । এই জেলায় জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদানের পরেই আমি বলেছিলাম সকল অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হবে এবং খালকে পুনঃখননের মাধ্যমে নতুন রূপ দেওয়া হবে । উচ্ছেদ হয়েছে , খাল পুনঃখনন চলমান রয়েছে নানান বাধা বিপত্তি আর মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার কারনে বারবার বিলম্বিত হয়েছে এর কাজ । দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে গিয়েছি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সেভাবেই নির্দেশনা দিয়েছি যাতে খালটি যথাসময়ে খনন করা হয়। আশা করছি এপ্রিল মাসেই খালটি খনন সম্পন্ন হবে। খালের জন্য একটি নান্দনিক ডিজাইন করে সেটির ডিপিপি প্রস্তুত করে তা অনুমোদনের প্রক্রিয়াধীন।

সুপ্রিয় সম্মানিত জেলাবাসী, আপনারা জানেন যে সাতক্ষীরা শহর তথা জেলাব্যপী জলাবদ্ধতা একটি বড় সমস্যা। বিভিন্নভাবে মৎস্যচাষী এবং মৎস্য ঘের মালিকরা
নেট পাটা দিয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে এই সমস্যা সৃষ্টি করে। গতবছর আমরা জেলাব্যাপী নেট পাটার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালিয়েছিলাম এবং সফল হয়েছিলাম কিন্তু মানুষের উগ্র লোভী মনোভাবের কারনে সেই সফলতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মানুষের ভেতরে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে । আপনারা জানেন যখন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল তখন আমরা দিনরাত প্রচার প্রচারণা এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলাম , মানুষের মাঝে পরিচ্ছন্নতার বোধ জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলাম। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে জেলার সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে সাথে নিয়ে একযোগে ক্লিন সাতক্ষীরা,গ্রিণ সাতক্ষীরা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল যা জেলার প্রতিটি মানুষের কাছে পৌছে গিয়েছিল কিন্তু করোনা প্যান্ডেমিক আমাদের কিছুটা থামিয়ে দিলেও সেই চেতনা থেকে সরাতে পারেনি।

সম্মানিত জেলাবাসী , জেলা প্রশাসক হিসেবে এই জেলায় ২.৫ বরছ পূর্তিতে আমি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি
এবং আপনাদেরকে অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। নো মাস্ক ,নো সার্ভিস । নো মাস্ক, নো আউটগোয়িং । নিজেরা সচেতন হোন ,অন্যদের সচেতন করুন । যারা এখনো ভ্যাক্সিন নেন নি ,রেজিস্ট্রেশন
করুন , ভ্যাক্সিন নিন।
আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করছি ।

এস এম মোস্তফা কামাল
জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট
সাতক্ষীরা।





০ মন্তব্য

আরও পোস্ট পড়ুন

মতামত দিন