পাবনায় ট্রিপল মার্ডার
মাতৃত্বের_লোভ_বনাম_সম্পদের_লোভ
০৫/০৬/২০২০খ্রিঃ তারিখ দুপুর অনুমান ১৩.২০ ঘটিকার সময় পাবনা থানাধীন দিলালপুর ফায়ার সার্ভিস এর পার্শ্ববর্তী এলাকা হইতে বিভিন্ন লোকজন থানায় খবর দেয় যে, ফায়ার সার্ভিস এর পার্শ্বে অবসর প্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আঃ জব্বার এর ভাড়া বাড়ী হইতে উৎকট পঁচা গন্ধ পাওয়া যাইতেছে। উক্ত সংবাদ পাওয়া মাত্র পাবনা জেলার অফিসার-ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। বাড়ীর ভিতরে উৎকট পঁচা গন্ধসহ বাড়ীর মেইন দরজা তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায়। উপস্থিত লোকজনের সহায়তায় মেইন দরজার তালা ভাংগিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলে গন্ধের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পায় কিন্তু বাড়ীর ভিতরে আরো কক্ষ গুলো তালাবদ্ধ থাকায় পশ্চিম পার্শ্বের কক্ষের জানালা দিয়ে ভিতরে খাটের উপর অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আঃ জব্বার এর মৃতদেহ এবং পূর্ব পার্শ্বের কক্ষের জানালা দিয়ে তাহার স্ত্রী ছুম্মা বেগম ও মেয়ে সানজিদা @ জয়া এর মৃতদেহ খাটের উপর পঁচা অর্ধগলিত অবস্থায় দেখিতে পাওয়া যায়। মুহুর্তেই অবসর প্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তাসহ একই পরিবারের তিন সদস্য নিহত হওয়ার বিষয়টি পাবনা শহরে বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ে এবং সাংবাদিকসহ আইন শৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট,ডিবি, সিআইডি, পিবিআই এর সদস্যগণ উপস্থিত হন। সিনিয়র পুলিশ অফিসারসহ পাবনা থানা ও ডিবির একাধিক টিম গঠন করে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। সেই সাথে ঘটনাস্থলের আলামত-এর যথাযথ সংরক্ষনের নিমিত্তে সিআইডি ফরেনসিক বিভাগ, রাজশাহী হইতে বিশেষজ্ঞ টিমকে তলব করা হয়। পরবর্তীতে সিআইডি বিশেষজ্ঞ টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইলে তালাবদ্ধ কক্ষগুলোর তালা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করিয়া তাদেরকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নৃশংস ভাবে হত্যা করাসহ ঘরের জিনিসপত্র এলোমেলো অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। সিআইডির বিশেষজ্ঞ টিম অত্যন্ত সতর্কতার সহিত হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত আলামত সমূহ পরীক্ষা এবং জব্দতালিকামূলে জব্দ করেন। পুলিশের একটি টিম লাশের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও অন্যান্য টিম পুলিশ সুপার, পাবনা জনাব শেখ রফিকুল ইসলাম, বিপিএম,পিপিএম এর নিদের্শনা মোতাবেক হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনসহ আসামী গ্রেফতারের বিষয়ে তৎপরতা শুরু করে। পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত জনাব গৌতম কুমার বিশ্বাস এর নেতৃত্বাধীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেল মোঃ ইবনে মিজান, অতিঃ পুলিশ সুপার (সদর) খন্দকার রবিউল আরাফাতসহ থানা পুলিশ ও ডিবি, পাবনার অফিসার ফোর্স এর সমন্বয়ে গঠিত একটি চৌকস টিম অতি অল্প সময়ের মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও আনুষঙ্গিক তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করে হত্যাকান্ড সংগঠনকারী ব্যক্তিকে সনাক্ত করে এবং সন্দেহভাজন জড়িত আসামীকে গ্রেফতারের লক্ষ্যে ডিবির উক্ত টিম অভিযান শুরু করে। একপর্যায়ে উক্ত চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ড সংগঠনকারী আসামী তানভীর হোসেন (২৫), পিতা- মৃত হাতেম আলী, সাং- হরিপুর, থানা- মহাদেবপুর, জেলা- নওগাঁকে তার নিজ বাড়ী হইতে গ্রেফতার করিতে সক্ষম হয়। গ্রেফতারের পরে তাকে জেলা গোয়েন্দা শাখা, পাবনা অফিসে নিয়ে এসে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করিলে একে একে সে এই লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিতে থাকে।
মূল_রহস্য
মাতৃত্বের লোভ বনাম অর্থের লোভ !!
নিঃসন্তান দম্পত্তির মা-বাবা হওয়ার তীব্র আকাংক্ষাই তাদের এই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অবসর প্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আঃ জব্বার চাকুরীজীবন শেষ করিলেও নিজ ঔরষে জন্মগ্রহণ করেনি কোনো সন্তান। বাধ্য হয়ে একদিন বয়সী সানজিদাকে সন্তান হিসাবে লালন পালন করিতে থাকে। মৃত্যুকালে সে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। সানজিদাকে মেয়ে হিসাবে লালনপালন করিলেও বাড়ীর পার্শ্বে থাকা ফায়ার সার্ভিস মসজিদের ইমামতি করা তানভীর হোসেন এর আচার ব্যবহারে সন্তষ্ট হয়ে তাকেও সন্তানের মত ভাবতে থাকে মৃত ছুম্মা বেগম। যদিও তাদের পরিচয় ইমামতি করার পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস মোড়েই তানভীর কর্র্তৃক পরিচালিত দোকান থেকে চাল কেনার সূত্র ধরে। প্রায় দেড় বছর পূর্বে হয় এই পরিচয়। দিনে দিনে বাড়তে থাকে সম্পর্কের গভীরতা। একপর্যায়ে সম্পর্কটা রুপ নেয় মা-ছেলের। তানভীর ছুম্মা খাতুনকে মা বলেই ডাকতো। সেই সূত্রে তানভীরের অবাধে যাওয়া আসা ছিল অবসর প্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আঃ জব্বারের বাড়ীতে। একপর্যায়ে আঃ জব্বার নিজেও তানভীরকে ছেলের মতই বিশ্বাস করে এবং পরিবারের সমস্ত কিছুই তার সাথে শেয়ার করে। এমনকি ব্যাংক, পোষ্ট অফিস হইতে টাকা তোলার সময়ও তাকে সাথে নিয়ে যেত। আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তার পরিবার জীবনে। ব্যাংক কর্মকর্তা ও তার স্ত্রী তাকে এতটাই আপন করে নিয়েছিল যে, রোজার সময় সেহেরী, ইফতারসহ তিন সন্ধ্যায় তাকে সাথে নিয়ে খাবার খেত। তারা তাকে আপন করে নিলেও তানভীর কখনোই তাদেরকে আপন মনে করেনি। সে মনে মনে তৈরী করে ভয়ংকর পরিকল্পনা, আঁকতে থাকে বাড়ীর টাকা পয়সা লুট করার ছক আর অপেক্ষা করে সুযোগের। তার এ পরিকল্পনা মতেই সে নিজেকে আইনের চোখ ফাকি দিতে গত ২৯/০৫/২০২০খ্রিঃ তারিখে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যায়, কিন্তু ছুটি শেষ না হলেও ইং ৩১/০৫/২০২০ খ্রিঃ তারিখ পাবনা আসে এবং রাত্রী অনুমান ১০.৩০ ঘটিকার সময় যমদুত হয়ে প্রবেশ করে অবসর প্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আঃ জব্বারের বাড়ীতে। কোনো কিছু না বুঝেই আঃ জব্বার একই বিছানায় নিজের পাশে ঘুমানোর স্থান দেয় তাকে। একে একে বাড়ীর সবাই ঘুমিয়ে গেলেও তানভীর পার করে নির্ঘুম রাত। অপেক্ষা করিতে থাকে সুযোগের। রাত্রী অনুমান ০২.০০ ঘটিকার সময় একবার বিছানা হইতে উঠে গোটা বাড়ীর পরিবেশ পর্যবেক্ষন করে। প্রস্তুত করে রাখে হত্যাকান্ড ঘটানোর সব ধারালো চাকু ও কাঠের বাটাম। যাতে কোনো ভাবে তার উদ্দেশ্যে ব্যর্থ না হয়। আবারো এসে শুয়ে পড়ে আঃ জব্বারের পাশে। রাত যখন ঠিক ০৪.০৫ মি. আঃ জব্বার বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠতে গেলে পেছন থেকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে একই বিছানায় শুয়ে থাকা যমদুত তানভীর। বয়ঃবৃদ্ধ আঃ জব্বার শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু হতে বাঁচার জন্য তানভীরের ডান হাতের আঙ্গুলে কামড়ে ধরে। এতে তার একটি আঙ্গুল কেটে যায়। এতেও ক্ষান্ত হয়না তানভীর। গামছা দিয়ে আরো শক্ত করে গলা পেঁচিয়ে ধরে। একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে বিছানায় পড়ে যায় আঃ জব্বার। সাথে সাথে তানভীর জব্বারের বুকের উপর চালিয়ে দেয় ধারালো চাকু। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে পড়ে গোটা ঘরে। আঃ জব্বারের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে পাশের রুমে যায় ঘাতক তানভীর। সেখানে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল ছুম্মা বেগম ও মেয়ে সানজিদা। মশারীর দড়ি কেটে দিয়েই তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে ঘাতক তানভীর। প্রথমেই ছুম্মা বেগমকে ধারালো চাকু দিয়ে একের পর এক আঘাত করিতে থাকে। ঘুমন্ত ছুম্মা বেগমের গলার রক্তের গড়গড় শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় সানজিদার। সে উঠে চিৎকার দিতে গেলে তাকেও ধারালো চাকু দিয়ে আঘাত করে ঘাতক তানভীর। চাকুর আঘাতে সে বিছানায় পড়ে গেলে ঘাতক তানভীর হাতে তুলে নেয় কাঠের বাটাম। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নৃশংস ভাবে উভয়ের মাথায় আঘাত করে।
একপর্যায়ে দু’জনেই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। চাবি দিয়ে একে একে খুলে বাড়ীর সব আলমারী, ওয়ার ড্রব। লুট করে নেয় ২০০০০০/= টাকা , ১০০০০০ ভারতীয় রুপী ও স্বর্নের গহনা। লুটপাট শেষে তানভীর পূনরায় যায় আঃ জব্বারের ঘরে। তখনও চলছিল আঃ জব্বারের শ্বাস প্রশ্বাস। সে টুকুও অবশিষ্ট রাখেনি ঘাতক তানভীর। ফিরে যায় পার্শ্বের রুমে হাতে তুলে নেয় কাঠের বাটাম, এসে উপর্যোপুরি আঘাত করে আঃ জব্বারের মাথায়, এইবার সত্যিকার ভাবে নিশ্চিত হয় আঃ জব্বারের মৃত্যু। তারপর বাথরুমে গিয়ে রক্ত মাখা কাপড় চোপড় ধুয়ে গোসল করে বাড়ীর সমস্ত গেটে তালা দিয়ে সন্তোর্পনে বাড়ী থেকে বেড়িয়ে পড়ে । ইতিমধ্যেই মসজিদের মাইকে ভেসে উঠে ফজরের আযানের ধ্বনি। যে ঈমাম মুসল্লিদের নামাজের ঈমামতি করতো সে আযানের ধ্বনি শুনেও মসজিদে নামাজ না পড়ে রাতভর চালানো হত্যাকান্ডের দায় হতে নিজেকে বাঁচানোর জন্য রওনা দেয় নিজ বাড়ীর উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে নাটোরে কোনো এক ডাক্তারের দোকান থেকে চিকিৎসা করায় তার কেটে যাওয়া আঙ্গুলের। চিরতরে শেষ হয়ে যায় নিঃসন্তান দম্পত্তির বাবা-মা হওয়ার ইচ্ছা, স্তম্ভিত হন জিজ্ঞাসাবাদে জেলা পুলিশ, পাবনার বিভিন্ন পর্যায়ের অফিসার ফোর্স। উক্ত হত্যাকান্ডের ঘটনায় ইতোমধ্যেই পাবনা সদর থানায় মামলা রুজু হয়েছে। গ্রেফতারকৃত আসামীর দখল হইতে লুট করা টাকা ও স্বর্ণের গহনা উদ্ধার করা হইয়াছে।