মাগুরায় পুলিশের কনেস্টেবল পদের মৌখিক পরীক্ষার পর চূড়ান্ত ফলাফলে নাম ঘোষণার পর আনন্দে কেঁদে ফেললেন তপতী চক্রবর্তী। পিতৃহীন হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে হিসেবে চাকুরিটা তার কাছে পৃথিবী হাতের মুঠোই পাওয়ার মত ঘটনা। কিন্তু দারিদ্রতার দাবানলে পিষে থাকা তপতীর পরদিন আর মেডিকেল পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ছয় হাজার টাকা নেই তার বিধাব মা’য়ের কাছে। যে কারণে চূড়ান্ত নাম ঘোষণার পর আনন্দের সাথে সাথে দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না তার, এই টাকার যোগান দেবার মতো সাধ্য নেই তাদের। অবশেষে মাগুরার সুযোগ্য পুলিশ সুপার খান মুহাম্মদ রেজোয়ান মহানুভবতায় এগিয়ে এলেন তার পাশে। আর সেইসাথে দুশ্চিন্তাও দূর হলো তার।
তপতীর অর্থনৈতিক অসহায়ত্বর কথা জানতে পেরে মাগুরার পুলিশ সুপার নিজেই এই টাকা দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন। সেই সাথে ভাগ্য ফিরলো তপতীর। আর বিনা পয়সায় পুলিশের চাকুরীর সাথে মেডিকেলের খরচও বহন করতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে পাশে দাড়াবার মাধ্যমে অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন মাগুরার পুলিশ সুপার খান মোহাম্মদ রেজওয়ান।
পুলিশের কনেস্টেবল পদে বাছাই পর্ব ও লিখিত পরীক্ষার পর শনিবার মাগুরা পুলিশ লাইনস্ এ ২৬ জন পুলিশ সদস্য নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষার সময় এমন এক ঘটনার সাক্ষী হয় সেখানে উপস্থিত সকলে।
মাগুরার শালিখা উপজেলার বুনাগাতী গ্রামের সরকারি খাস জমিতে খুপড়ি ঘরে হতদরিদ্র তপতীদের বসবাস। বাবা তপন চক্রবর্তী একটি বেসরকারি কোম্পনীর বিপনন কর্মী ছিলেন। ২০১৪ সালের ১৪ মে এক সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান তিনি। সেই থেকে তপতী তার বিধবা মা ও ছোট বোন নিয়ে চরম দারিদ্রতার মাঝে খেয়ে না খেয়ে কোন রকমে জীবন যাপন করেছেন। একমাত্র মামা ফরিদপুরে একটি পেট্রোল পাম্পের কর্মচারীর চাকুরী করেন, প্রতিমাসে তার পাঠানো সামান্য টাকায় তাদের চলে সংসার। খেয়ে-না খেয়ে দিন পার করে চরম অনটনের সংসারে থেকেও লেখা পড়া চালিয়ে গেছেন তপতী। শালিখার বুনাগাতি কলেজে এবার বিজ্ঞান বিভাগের এইচএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী সে । একমাত্র সাহায্যকারী মামার বিয়ের কথা চলছে, বিয়ে হলে সংসারের চাপে ইচ্ছা থাকলেও তিনি তাদের জন্য আর খরচের টাকা দিতে পারবেন না বলে শংকিত সে, এবার বুঝি তাদের কপালে দুর্ভোগের শেষ নেই। যে কারনে দ্রুত একটা কিছু আয় রোজগারের পথ করতে হবে তাকে। এরই মাঝে কোন টাকা ছাড়াই মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পুলিশ কনেস্টবল পদে নিয়োগের খবর জানতে পারে সে। খবরটি শুনে মনের মধ্যে স্বপ্ন বোনেন তপতী। এই চাকরিটা পেলে নিজের ও ছোট বোনের লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারের প্রয়োজন মিটাতে পারবেন বলে। অসহায় বিধাব মাকে আর দারিদ্র্যতার কষ্টে চোঁখের জ্বলে ভাসতে হবে না।
এর প্রেক্ষিতেই লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হবার পর শনিবার মৌখিক পরীক্ষায়ও চুড়ান্তভাবে মনোনিত হন তপতী। এ চাকরির জন্য ব্যাংক ড্রাফট করতে তার খরচ হয়েছে মাত্র ১০০ টাকা।
কিন্তু পরদিন রোববার মেডিকেল পরীক্ষার জন্য ৬ হাজার টাকার প্রয়োজন। যার কোন যোগান নেই তপতী ও তার বিধাব মায়ের কাছে। ছয় হাজারতো দূরের কথা পরদিন বাড়ি থেকে মাগুরায় আসা-যাওয়ার ভাড়ার টাকাও জোগাড় করতে হবে ধার দেনা করেই। আর সে কারনেই চাকুরী পাবার আনন্দে কেঁদে ফেললেও চোখে মুখে দুঃচিন্তার ছাপ ফুটে উঠে ছিল তার।
অবশেষে পুলিশ সুপার খান মুহাম্মদ রেজোয়ান কোন একটি মাধ্যমে জানতে পারেন যে মেডিকেলের চেক আপের ৬০০০ টাকা জোগাড় করার সামর্থ নেই তপতীর। এ সময় তিনি নিজে তপতীকে খুজে এনে তার মেডিকেল চেক আপরে প্রয়োজনীয় পুরো টাকার দায়িত্ব নেন।
তপতীর মা চন্দনা চক্রবর্তী বলেন, বিনা টাকায় মেয়ে পুলিশের চাকরি পাওয়ায় তিনি ভিষণ খুশি। এ প্রাপ্তির মাধ্যমে তাদের দুঃখের দিন এবার শেষ হবে বলে তিনি আশা ব্যাক্ত করেন।
পুলিশ লাইনসে আসা চাকরী প্রাপ্তদের মধ্যে মেহেদী হাসান, আল ইমরান, ইব্রাহিম হোসেন জানান, বিনা ঘুষ বা বাড়তি কোন খরচ ছাড়া মাত্র ১০০ টাকা ব্যাংক ড্রাফটে তারা এবারের পুলিশের চাকরী পেয়েছেন। তাদের প্রত্যেকেরই মন্তব্য ছিলো, তারা হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান ঘুষ বা বাড়তি খরচ দিতে হলে তাদের কপালে আর চাকরি জুটতো না। এ সুযোগ করে দেবার জন্য তারা মাগুরা পুলিশ সুপার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ ধন্যবাদ জানান।
মাগুরা পুলিশ সুপার খান মুহাম্মদ রেজোওয়ান বলেন, পুলিশের চাকরীর সাথে মানবিক সেবার সম্পর্ক জরুরী। এটি একটি পবিত্র দায়িত্ব। তিনি সেই দায়িত্বটি পালন করেছেন মাত্র। তবে সুষ্ঠুভাবে চাকুরির নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পাদনের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান মাগুরার সর্বস্তরের জনগন, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক, সামাজিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক, সর্বপরী পুলিশ প্রধান আইজিপি মহোদয় ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর।
মাগুরা প্রতিনিধি বলেন, নিয়োগ বোডে পুলিশ সুপার সহ বাহিরের জেলার সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পদন্নোতি প্রাপ্ত পুলিশ সুপার) মোহাম্মদ ইলতুৎ মিশ ও খুলনা বি সার্কেলের এডিশনাল এসপি সজিব খান নিয়োগ বোর্ডের সদস্য হিসাবে উপস্থিত ছিলেন।তিনি আরো বলেন টোটাল নিয়োগ প্রক্রিয়া টি পুলিশ হেড কোয়ার্টাস থেকে আগত গোয়েন্দা টিম চুলচেরা বিশ্লেষন করে তারপর নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে।শুধু মাত্র ব্যাংক চালান ১০০ টাকা ছাড়া অতিরিক্ত কোটা টাকা কনস্টেবল নিয়োগে লাগেনি।