পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন
আবদুস সামাদ ফারুক:
করোনা ভাইরাসের নৃশংস আঘাতে সায়ত্রিশ লক্ষের অধিক মানুষ আক্রান্ত এবংপ্রায় তিনলক্ষ মানুষ নিহত।বিশ্বের ২১২ টি দেশ ও অন্চল এই বিভীষিকাময় মহামারীতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র,স্পেন,ইটালী,যুক্তরাজ্য,ফ্রান্স,জার্মানী,রাশিয়া,তুরস্ক,ব্রাজিল,ইরান,চীন,কানাডা,পেরু,বেলজিয়াম,নেদারল্যান্ডস,ইকুয়েডর,সউদী আরব।বাংলাদেশ,ভারত,পাকিস্তান,আফগান্তানও মারাত্মকভাবে আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত।
মৃত্যুর মিছিল,মৃত্যু ভয়,আতন্ক,কার্ফু,লকডাউন,গৃহবন্দীত্ব,দেখা মাত্র গুলি,প্রশাসনের সহায়তায় সেনাবাহিনী,চিকিৎসা সামগ্রী সংকট বিশেষ করে পিপিই,মাস্ক,ভেন্টিলেটর,ডাক্তার ও নার্স,বেড সংকট,করোনা সন্দেহে বৃদ্ধা মাকেজংগলে ফেলে দেয়া,করোনায় মৃতের দাফন কাফনে নিকট আত্মীয়রা থাকতে ভীত,অতিদরিদ্রদের খাদ্য অভাব,লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন,সরকারের বিস্তৃত খাদ্য সহায়তা,ঘরে ঘরে খাদ্য পৌছে দেয়া,শারীরিক দূরত্ব মান্যকরন শহরে থেকে গ্রাম পর্যন্ত এক বহুমাত্রিক অবস্থার সৃষ্টি করেছে।এর সাথে যুক্ত হয়েছে কয়েক লক্ষ গার্মেন্টস কর্মীদের ঢাকায় আসা আবার ফেরত যাওয়া এবং আবার পায়ে হেটে আসা।প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম একেচীনের তৈরী জীবানু বলে অভিযোগ করেছেন।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন এবং অর্থ বন্ধ করে দিয়েছেন।
এ সমস্যাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর অভাবনীয় পরিস্থিতির সাথে অনেকাংশে তুলনা করা যায়।এই মহামারী বিশ্ব অর্থনীতি,জীবন জীবিকা,স্বাস্থ্য ব্যবস্থা,শিক্ষা ব্যবস্থার উপর এক গভীর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে যার প্রভাব হবে দীর্ঘ মেয়াদী।আই এম এফ পূর্বাভাষ দিয়েছে ষাট বছরের মধ্যে প্রথমভার এশিয়ার প্রবৃদ্ধি হবে শূন্য কোটা।দক্ষিন এশিয়া গত এক দশক ধরে যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছিল তা থুবড়ে পড়ার শংকা।কর্মহীন মানুষের সংখ্যা খোদ যুক্তরাষ্ট্রে হবে ২০% এবং উন্নত ও উন্নয়নগামী দেশগুলোতে তা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।ইতোমধ্যে মধ্যপ্রচ্যের দেশ থেকে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো শুরু হয়েছে।বাংলাদেশের রপ্তানী খাত বিশেষ করে তিরী পোশাক শিল্প ঝুঁকি ও চ্যালেন্জের সম্মুখীন হবে।
ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী তৈরী পোশাক,কৃষি সহ অন্যান্য সেকটরে প্রনোদনা ও পুনর্বাসন কর্মসূচী ঘোষনা করেছেন।
প্রায় চারকোটি মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে,এক কোটি মানুষকে রেশনিংএর আওতায় আনার কর্মসূচী নেয়া হয়েছে।৯৫৬১৯ কোটি টাকা যা জিডিপির ৩.৩% অর্থনৈতিক সহায়তা প্যাকেজ ঘোষনা করা হয়েছে।স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন,কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি তথা খাদ্য নিরাপত্তা প্রাধান্য পাবে সংশোধিত বাজেটে ওপরবর্তী তিনবছরের বাজেট।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার না খেয়ে তিন কোটি মানুষ মারা যাওয়ার পূর্বাভাষ রয়েছে।আনন্দের বিষয় হাওর এলাকার বোরো ফসল প্রায় ঘরে উঠেছে।আগাম বন্যা ও শিলা বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ায় দেশের অন্যান্য অন্চলের ফসল ঘরে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই মহামারী মোকাবেলায় সরকারী যন্ত্র বিশেষ করে ডাক্তার,নার্স,মাঠ প্রশাসন,পুলিশ,সেনাবাহিনী,গনমাধ্যম কর্মী মানুষের হৃদয়ে পৌছতে পেরেছেন।পাশাপাশি দেশ প্রেমিক মানুষ সামাজিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর ফসল কাটার আহবান গভীর সাড়া ফেলেছে।প্যান্ট শার্ট পড়া ভদ্রলোকেরা সাময়িক ভাবে কামলার ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছেন।উৎসবের মেজাজও লক্ষ করা গেছে।
এই রোগের প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞানীরা চেষ্ঠাকরে যাচ্ছেন।ভেকসিন পেতে আরো সময় লাগবে।এই রোগ বুঝিয়ে দিলো ” সময় নেই, সময় নেই ” বলে যে চিল্লা চিল্লি চলছিল সেই সময় এখন পেয়ে গেলে।এই সময়কেও অনেকেই কাজে লাগাতে পারেনি,নষ্ট করেছে,অপচয় করেছে।ভোগ,উন্নয়ন,ব্যবসা বানিজ্যের অসম প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত হয়েও পৃথিবী চলতে পারে।এই বন্দী দশায় প্রকৃতি পেয়েছে পূর্ন শক্তি,বইছে দখিনা বাতাস।মাটি,পানি,বাতাস আজ আনেকাংশে বিশুদ্ধ।ঢাকার বায়ু দূষন মাত্রা উঠেছিল ৫২৭ যা মহা বিপদজনক তা এখন ১৫০ এর কম বা কাছাকাছি।যে ঢাকা এক দন্ডের জন্য ঘুমাত না সে ঢাকায় ফুল,পাখীর কলরব,বৃক্ষে নতুন প্রানের জাগরন।ককসবাজারের সমুদ্র সৈকতে বহু বছর পর লাল কাকড়ার বিচরন, দেখা যাচ্ছে ডলফিনের মাতামাতি।
করোনার ভয়াবহতা চলছে,বহু মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এ এক দুর্বিষহ বৈরী সময়।জীবনানন্দ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দেখেছিলেন,করোনা দেখতে হয়নি।অনেক কষ্টে লিখেছিলেন “পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন”।যদিও জীবনানন্দ এ রকম পংকতি লেখার জন্য জন্ম নেননি।কলমীর গন্ধ,বেত ফলের ম্লান দুঃখ,সোনালী ডানার চিলের কান্না,ধানসিড়ির মায়াবী রূপ বর্ননার জন্যই পৃথিবীতে তিনি এসেছিলেন।তাঁর লেখার কথা নয় পৃথিবীর অসুখ কিংবা অদ্ভুত এক আধাঁর।
করোনা একদিন বিদায় নিবে।কিন্তু গভীর ক্ষত রেখে যাবে।অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষরণ শুকাতে বহু সময়
লাগবে।করোনা পূর্ব পৃথিবীর অনাচার ও দুরাচার যেন আবার ফিরে না আসে তা পৃথিবীবাসীকে ভাবতে হবে।করোনা পরবর্তী পৃথিবী হোক নাগিনীর নি:শ্বাস মুক্ত।এই বৈরীসময় যে শৃংখলা,মানবিকতা ও সহমর্মিতা শেখালো তার চর্চা করে এক শান্তিময় পৃথিবী আমরা দেখতে চাই।মানবিকতার বাঁধনে আমাদের পৃথিবী হয়ে উঠুক আপন বসত বাড়ী।
লেখক:মো: আবদুস সামাদ
সাবেক জেলা প্রশাসক, সাতক্ষীরা
সাবেক বিভাগীয় কমিশনার,খুলনা ও
সদ্য অবসর প্রাপ্ত সিনিয়র সচিব,নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়,বাংলাদেশ।