মানব সেবায় উৎসর্গকৃত এ পেশা আমার আমার গর্ব ও অহংকার : হেড কোয়াটার্স ডিআইজি আমিনুল ইসলাম

দ্বারা zime
০ মন্তব্য 238 দর্শন

 

আমি বাংলাদেশ পুলিশের একজন সাধারণ সদস্য। আমি আমার পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মানব সেবায় উৎসর্গকৃত এ পেশা আমার অহমিকা, আমার গর্ব, আমার অহংকার। আমার প্রাণ-মন জুড়ে মানুষের প্রতি যে ভালবাসাপূর্ণ অনুভব, সেই ভালবাসার প্রায়োগিক ও ফলিত রূপ এবং বাস্তবতা আমি দেখতে চাই। আমি অনুভব করতে চাই মানুষের হৃদয় স্পন্দন; গভীর আপনবোধে, সুগভীর স্নেহে ও মমতায়। সুশীল ও শিষ্টের পালনে আমার মুষ্টিবদ্ধ হাত দৃঢ় প্রত্যয়ে রুখে দেয় সকল অন্যায়, অপরাধ আর নিষ্ঠুরতা। দেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষায় আমি দৃঢ়সংকল্প, বদ্ধপরিকর। আমি নির্ভীক, নিঃশঙ্ক, অকুতোভয় রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, আইনের প্রয়োগে। আমি ধারণ করি ঐতিহ্য- ঐতিহাসিক বাস্তবতায়, অসীম গৌরবে।

আমি ট্রাফিক পুলিশ। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, গরমে ঘেমে আমি সড়ক, মহাসড়ক রেখেছি সচল। ফুরফুরে শীতল স্নিগ্ধ বাহনে বসে আমার পানে খানিক্ষণ তাখিয়ে দেখুন। আমার সকল মনঃসংযোগ, সকল অভিনিবেশ ও প্রচেষ্টা আপনাতে কেন্দ্রীভূত। আপনাকে গন্তব্যে পৌছে দিতে আমার যথাসাধ্য আয়োজন। সেই পথে যেতে যেতে যদি বা আপনি দৈবাৎ দুর্ঘটনায় আহত হন, আমিই হয়তো আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি হাসপাতালের শুশ্রুষায়- আপনার মঙ্গল আর সুস্থতা কামনায়।

আমি মেট্রোপলিটনে কাজ করি। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটে আমার পদায়ন। জঙ্গির হাত আমি দুমড়ে দেই, মুচরে দেই কঠোর প্রতিজ্ঞায়। আপনাকে অক্ষত রাখতে বুক পেতে দেই তাজা বুলেট-গ্রেনেড-বোমায়। কল্যানপুরে আমি আহত হই। সিলেটে আলিঙ্গন করি মৃত্যুর শীতল পরশ। জীবন দিয়ে আপনার জন্য নিরাপদ রাখি ভোজনালয়, উপাসনালয়, শিক্ষালয় এবং বিতানসমূহ।

আমি নৌ পুলিশের সদস্য। আমি দস্যুমুক্ত রাখি বিপুল জলরাশি। সহজ, শঙ্কামুক্ত হয় আপনার নৌ ভ্রমন। আমি সন্দুরবন থেকে উদ্ধার করি পথ হারিয়ে ফেলা অভিযাত্রিদল। আমি বন্দরসমূহে পৌঁছে দেই ঝড় সাইক্লোনের আগাম বার্তা। আমার ডুবুরিদল খোঁজে ফিরে তলিয়ে যাওয়া প্রাণ নদীর গহীনে, স্পন্দন তার ফিরিয়ে দিতে অপার মমতায়।

আমি এখন হাইওয়ে পুলিশে। ঈদ, পূঁজা পার্বণে আমি মহাসড়ক, সড়ক, রাস্তায়। কখনো নির্ঘুম রাত এবং রাতের পর রাত। ঈদের সকালে আপনি যখন আয়েশভরে ঈদের সুস্বাদু খাবার মুখে তুলে নিচ্ছেন, ছেলে মেয়ের হাত ধরে বেড়াতে বেরিয়েছেন- আমি তখনো মহাসড়কে যান সামলাই। আমার হৃদয় মন তখন আর্দ্র আপত্য স্নেহে। আমারও যে আপনার মতো ছেলে মেয়ে আছে। বাবার অপেক্ষায় তাদের ঈদের দিন কেটে যায় বেদনায়, বিষন্নতায়। কিন্তু আমার চোখে মুখে ক্লান্তিহিন অভিব্যক্তি কর্তব্যের কঠোর তপস্যায়। আপনি যে সঠিক সময়টায় ঈদের নামাজ পড়তে পেরেছেন সেই আনন্দের শিহরণ আমাকে তৃপ্তিদায়ক স্বস্তির অনুভবে শান্তির পরশ বুলায়।

আমি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশে। মিল কারখানায় যারা শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন তাদের নিরাপত্তা বিধান, মালিক শ্রমিকের সু-সম্পর্ক নিশ্চিতকরণে আমি প্রতিনিয়ত কাজ করে যাই। দৃঢ় হয় মালিক-শ্রমিক মেলবন্ধন। কারখানায় চাকাগুলি অবিরাম ঘুরে। বাড়ে শিল্প উৎপাদন, বাড়ে রফতানি আয়ও। দেশ ধাবিত হয় নিশ্চিত সমৃদ্ধি পানে। শ্রমিকের মতো আমার চোখেও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের হাতছানি- এক নিরাপদতর জীবনের প্রত্যাশা।

টুরিস্ট পুলিশেও আমি আছি। উদ্ধার করছি হারিয়ে যাওয়া শিশু, পর্যটকের মোবাইল। সমুদ্রসৈকত, পর্যটনকেন্দ্র, বিনোদন স্থলকে রাখি জঞ্জাল আর অপরাধমুক্ত আপনার নিশ্চিন্ত ভ্রমন প্রত্যাশায়।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। এখানে আমি বিস্মৃত প্রায় অপরাধের সূত্র বের করে নিয়ে আসি। খুঁজে বের করি ছগিরা মোর্শেদের হন্তারক দীর্ঘ ৩০ বছর পর। আমি তো হাল ছাড়িনি। অন্ধকারের গহীন থেকে আপনার জন্য নিয়ে এসেছি উজ্জ্বল প্রতীক্ষিত আলো। ফেনীর নুসরাত। অভাগা বোনটির ঝলসানো শরীর। আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সকল অরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাব। সেই প্রতিজ্ঞা আমি রক্ষা করেছি। বিচ্যুত হইনি মোটেও। শাস্তি নিশ্চিত করে অতঃপর আমার স্বস্তি।

রেলওয়ে পুলিশে আমি। বসার জায়গাটিও নেই। ভারী অস্ত্র কাঁধে ঘুরে বেড়াই বগি থেকে বগি। আপনার মূল্যবান সম্পদ রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব যে আমার। এমনকি দুষ্ট ছেলের দল যাতে ঢিলটিও না ছুড়তে পারে সে জন্য আমার সকল উদ্যম, সকল উদ্যোগ, সকল আয়োজন।

ব্যাটেলিয়ান পুলিশে আমি বিমান বন্দরকে রাখি নিচ্ছিদ্র নিরাপদ, দায়িত্বরত আমি আদালত স্থলে। সচিবালয়ের প্রবেশ মুখেও আমাকে আপনার চোখে পড়বে, দৃশ্যমান আমি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের নিরাপত্তায়।

RAB এ আমি প্রবল দুর্দমনীয় অপরাধ নির্মূলকরণের প্রতিজ্ঞায়। আমি করি জঙ্গি দমন, সুন্দরবন রাখি মুক্ত- জলদস্যুর আতঙ্ক হতে। মাদক নির্মূল, ভেজাল প্রতিরোধেও আমি দুর্ণিবার- নাগরিক স্বস্তির নিশ্চয়তায়।

আমি জেলায় কাজ করি। কাজ করি মেট্রোপলিটনে। আমার ভাবনা জুড়ে সর্বদাই আপনার নির্বিঘ্ন নিরাপত্তা। আপনি যখন শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন তখন আমি সতর্ক অতন্দ্র প্রহরায়। আমি হত্যার চিহ্নযুক্ত পঁচা গলা লাশ ঠেলা গাড়ি অথবা ভ্যানে করে বহু পথ বহু ঘন্টা পাড়ি দিয়ে সদরে নিয়ে যাই। সুরতহাল করি। অপরাধের সংঘটন প্রক্রিয়া উদঘাটন করি। অপরাধী চিহ্নিত করি আর হাজির করি আদালতের দোরগোড়ায়।

আপনার শরীরে যিনি আঘাত দিয়েছেন, যিনি আপনার সম্পদ লুটে নিয়েছেন, যিনি আপনার সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছেন, যিনি রাষ্ট্রদ্রোহী। তিনি যেমন আপনার শত্রু তেমনই আমারও। তার শাস্তি নিশ্চিত করার প্রয়াসে আমার সকল আয়োজন, সকল কর্মকান্ড, সকল প্রচেষ্টা, সকল প্রত্যয়। আইনের কঠিন শাসনের সাবধান বাণী প্রচার করতেও আমি বদ্ধপরিকর।

৯৯৯ এ আমি যে কোন সেবা দানকারী সংস্থার সাথে আপনার দ্রুত সংযোগ ঘটিয়ে সেবার হাতকে আপনার জন্য প্রসারিত করে রেখেছি। অ্যাম্বুলেন্স থেকে ফায়ার সার্ভিস পর্যন্ত আর পুলিশের যে কোন সেবার প্রাপ্যতা আমি শুধু আপনার জন্যই সহজ করে তুলেছি।

আমি আপনার অতি নিকটজন অতি কাছের মানুষ যাকে আপনি প্রত্যক্ষ করেন আপনার নানা প্রয়োজনে, পাশে পান নানামূখী সেবায়।

আপনি রাস্তায় একা। অন্ধকার পথে আপনি কোন অমঙ্গলের আশঙ্কা করছেন। সে আশঙ্কা অশরীরী হোক, বা হোক শরীরধারী চোর ছিনতাইকারী ডাকাতের। আপনি যদি নিকটেই আমায় দেখেন স্বস্তি কি ফিরে আসে না আপনার মনের কোনায়!?

আপনি আমার বোন, আপনি আমার কন্যা। বখাটের অশ্লীলতা থেকে আপনাকে সুরক্ষায় এগিয়ে এসেছি আমি, তাড়িত হয়েছি আমি পিতা অথবা ভাইয়ের কোমল প্রেরণায়।

করোনার এই মহামারীকালে আমি আবারও বাজি রেখেছি জীবন। সকলকে আমি স্বাস্থ্যবিধির আওতায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা গ্রহন করেছি। আমি আপনার বাসায় ত্রাণ পৌছে দিয়েছি। মৃত লাশ যখন নিকট স্বজনরাও গ্রহন করেনি তখন আমি তা বহন করেছি নিজ কাঁধে। আমি তাঁর দাফন দিয়েছি। তাঁর জন্য দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়েছি।

১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ। পাকিস্তানি সুসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে সামান্য রাইফেল সম্বল করে আমি প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি রাজারবাগে। বঙ্গবন্ধুর মহান আহ্বানে আমি স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, বিলিয়ে দিয়েছি তাজা প্রাণ। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমার এই দেশ। এই গৌরবের আমি অংশীদার। এ গৌরব আমায় প্রেরণা যোগায়- প্রতিক্ষণ, সারাক্ষণ।

দেশের প্রচলিত সকল আইন আমাতেও আরোপিত। আমার জন্য রয়েছে বাড়তি আরো কিছু কানুন এবং নিয়ন্ত্রনকারী বিধি। কোথাও যদি আমার স্খলন ঘটে, কোথাও যদি ঘটে বিচ্যুতি তবে আমার জন্য শাস্তির বিধান প্রস্তুত আছে। সেই বিধির আওতায় আমার শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।

প্রচলিত বিধানাবলীর কোথাও যদি কোন অসম্পূর্ণতা, কোন শূন্যতা, কোন অপূর্ণাঙ্গতা থেকে থাকে তবে সেগুলোর সম্পূর্ণতা আনয়নে আমরা আমাদের অবস্থান থেকে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারি। আর সেটিই নাগরিক হিসেবে আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। সে কাজটি না করে আমরা যখন দেশের প্রচলিত নিয়ম কানুন বিধির প্রতি প্রবল অবজ্ঞা আর বিতৃষ্ণা পোষণ করে কোন পেশা এবং পেশাজীবীর প্রতি ঢালাও রকমের অগ্রহনযোগ্য, অসত্য, অশোভন মন্তব্য ছুঁড়ে হালকা জনপ্রিয়তা অর্জনের প্রয়াস পাই তখন আমাদের এহেন আচরণ কতটা বাস্তবসম্মত এবং বিবেচনাপ্রসূত সে বিষয়ে ভাববার অবকাশ থেকে যায় বৈকি!!

একজনের অন্যায়ের জন্য অপরকে দায়ী করা যায় না। এটি মোটেও ধর্মীয় শিক্ষার অনুকূল আচরণ নয়। সামাজিক দৃষ্টিকোন থেকেও এহেন আচরণ অগ্রহনযোগ্য। রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনও এটি সমর্থন করে না। একজনের অপরাধে অথবা বিচ্যুতিতে যদি পুরো সার্ভিসের প্রতি বিদ্রুপাত্বক ভাষায় আক্রমনাত্বক আচরণ করা হয় তখন সেটা নিশ্চিতই ধর্মীয় ও সামাজিক গ্রহনযোগ্যতার গন্ডি পেরিয়ে কোথাও কোথাও আইনের সীমা অতিক্রম করে যায়।

আমরা নিজেদের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলোর খোঁজ খবর করে আত্মসমালোচনায় ব্রতী হতে পারি। এতে আমরা আরো পরিশুদ্ধ ও পরিশীলিত হতে পারব।

একটি সুন্দর, সহনশীল প্রত্যাশিত সমাজ গড়ায় সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের দায়িত্ববোধ এবং বিবেচনাপ্রসূত আচরণের বিকল্পটি নেই বলেই আমার সরল বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাসের সাথে সকলেই হয়তো একমত।

লেখক : মো: আমিনুল ইসলাম, ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (প্রশাসন এন্ড ডিসিপ্লিন), পুলিশ হেড কোয়াটার্স, বাংলাদেশ।





০ মন্তব্য

আরও পোস্ট পড়ুন

মতামত দিন