ভাতিজাকে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি পাইয়ে দিতে জামালপুর আদালতে কর্মরত উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ আলী ও কথিত সংবাদকর্মী খায়রুলের স্ত্রী শাহানাতুলের সঙ্গে ১০ লাখ টাকা চুক্তি করেছিলেন ওয়াজেদ আলী।
কিন্তু নিজেদের মধ্যকার বিতন্ডায় তাদের আটক করে টাঙ্গাইল জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। উদ্ধার করা হয় নগদ ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। ঘটনাটি গত শুক্রবার (২১) রাতের।
নারী কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার আশ্বাসে জুলহাস উদ্দিন (৪৮) নামে সাবেক এক আনসার সদস্যকে গ্রেফতার করেছে বগুড়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি মঙ্গলবার (২৫ জুন) দুপুরের।
ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে ৯ হাজার ৬৮০ জনের নিয়োগকে কেন্দ্র করে এভাবেই প্রতারক ও তদবিরবাজদের একের পর এক মিশন ভেস্তে যাচ্ছে।
পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ চলাকালে টাঙ্গাইল বা বগুড়ার এমন চিত্রই বলে দিচ্ছে ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে চূড়ান্ত অ্যাকশন চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর নেতৃত্বাধীন পুলিশ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবুজ সংকেতে দেশপ্রেমিক পুলিশ বাহিনীর ললাটে নিয়োগ বাণিজ্যের কলঙ্ক তিলক চিরতরে মুছে দিতে আইজিপি ‘জিরো টলারেন্স’ ভিত্তিতে কাজ শুরু করে এমন জোরদার অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।
পোস্টার, ফেস্টুন ও ফেসবুকে প্রচারের মাধ্যমে অনৈতিক লেনদেন বা ঘুষ না দিতে জনসাধারণকে পুলিশ গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি জানানোর ফলে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যেই এর সুফলও মিলতে শুরু করেছে।
স্থানীয় জনসাধারণও পুলিশকে তথ্য দিয়ে আপডেট রাখায় প্রতারকদের শেষ রক্ষা হচ্ছে না। এতে করে সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিক, তদবিরবাজরা আতঙ্কিত হলেও খুশি দেশের সাধারণ মানুষ।
কোথাও নগদ টাকা, কোথাও চেকসহ কোন রকম লেনদেন হলেই পুলিশের হাতে ‘ধরা’ পড়ছে প্রতারকরা। এতে বাদ যাচ্ছে না পুলিশ সদস্যরাও। পুরো নিয়োগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ ‘অ্যাকশন’ চলবে।
কনস্টেবল নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে এ অভিযান ফলপ্রসু হয়েছে বলে মনে করছেন পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। দুর্নীতি মুলোৎপাটনে পুলিশের এমন অভিযানে নিয়োগকে ঘিরে মৌসুমী রাজনীতিকরাও আত্মগোপন করেছেন।
সূত্র বলছে, এবার কোন রকম তদবির, সুপারিশ বা অনৈতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে পুলিশ কনস্টেবল পদে ‘কোটা’ মিলছে না এমন স্পষ্ট বার্তাও পেয়ে গেছেন সরকার দলীয় সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিক থেকে শুরু করে আমলা, সাংবাদিক এবং প্রভাবশালীরা।
এর সঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের তদারিক টিম এবং আইজিপির নিজস্ব গোয়েন্দা টিমের তৎপরতায় বেশ ‘সুবোধ’ বনে গেছেন এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তারাও।
দেশের প্রতিটি পুলিশ সুপারই (এসপি) পুলিশ প্রধান ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর, বিপিএম (বার) সঙ্গে সুর মিলিয়ে নিয়োগে নজিরবিহীন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে চাইছেন। গুরুত্বপূর্ণ এ নিয়োগকে ঘিরে সুযোগ সন্ধানী ও তদবিরবাজদের ‘রাশ’ টেনে ধরতে পুলিশ বেশ মনোযোগী।
তাদের নেওয়া কৌশলগুলো মাথায় রেখে পুলিশও পাল্টা কৌশল নেওয়ায় শেষতক এরা আর হালে পানি পাচ্ছে না!
পুলিশের একজন কর্মকর্তা প্রতিবেদক কে বলেন,, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স নীতির আলোকে পুলিশ প্রধান নিয়োগে দুর্নীতি নির্মূলের যে স্বপ্ন দেখছেন তা একবারেই সময়োচিত। প্রধানমন্ত্রী পুলিশসহ সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি দমনে সোচ্চার হয়েছেন।
এ বিষয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর শক্ত অবস্থানের দৌলতে এবার প্রতিটি জেলা পুলিশ সুপারকেও (এসপি) এ ইস্যুতে বেশ সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। দুর্নীতির আবর্ত থেকে বাহিনীকে মুক্ত করতে তাঁরা আইজিপিকে কাঙ্খিত ফল উপহার দিতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করছেন।
অ্যাকশনের খন্ড খন্ড চিত্র এবং এসপিদের ভাষ্য:
পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণার অভিযোগে সাতক্ষীরায় বল্লী এলাকায় বাড়ি প্রতারক আসাদুজ্জামান(২৭) ও প্রতারক দেলোয়ার হোসেন(২১) কে নগত ১১ লক্ষ টাকা সহ হাতেনাতে আটক করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।
এবিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মোঃসাজ্জাদুর রহমান বিপিএম প্রতিবেক কে বলেন নিয়োগের ১০ দিন আগে থেকে জেলাব্যাপি মাইকিং করা হয়েছে যে কোন ব্যক্তি/প্রার্থী পুলিশে চাকুরীর জন্য কারো কাছে টাকা দিয়ে প্রতারিত হবেন না।মাইকিংয়ে আরো বলা হয় কোন রকম তদবীর বা ঘুষে এবার কনস্টেবল এ চাকুরী হবেনা।সম্পূর্ণ মেধা ও যোগ্যতায় পুলিশের চাকুরী হবে।
পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণার অভিযোগে বগুড়ায় এ পর্যন্ত পৃথকভাবে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে জেলা পুলিশ। তাঁরা হলেন- বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের রেকর্ড কিপার আনোয়ার হোসেন (৩৫), আহসানুল কবির (৪০) ও সাবেক আনসার সদস্য জুলহাস উদ্দিন (৪৮)।
জানতে চাইলে বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) আলী আশরাফ ভূইয়া বলেন, ‘পুলিশে চাকরি পেতে ১০৩ টাকার বেশি লাগে না এ প্রচারণার সুফল আমরা পাচ্ছি। স্থানীয় জনসাধারণ আমাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন।
আইজিপি মহোদয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশনায় আমরা এ নিয়োগে শতভাগ স্বচ্ছতা বজায় রাখবো। শুধুমাত্র স্বচ্ছতার মাপকাঠিতেই সবাই নিয়োগ পাবেন।’
টাঙ্গাইল জেলায় কনস্টেবল পদে চাকরি দেয়ার কথা বলে ১০ লাখ টাকা লেনদেনের সময় হাতেনাতে পুলিশের এক উপ-পরিদর্শক (এসআই) ও এক কথিত সংবাদকর্মীর স্ত্রীর আটকের ঘটনাটি সবার মুখে মুখে। এ বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সঞ্জিত কুমার রায় বলেন, ‘আগামী ১ জুলাই কনস্টেবল পদে নিয়োগে সরকারি নির্ধারিত পরীক্ষার ফি ১০০ টাকা ও ফরমের মূল্য তিন টাকা।
এছাড়া আর কোনো টাকা লাগবে না। তারই ধারাবাহিকতায় ওই দুই আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ বিষয়ে আবারো কেউ অবৈধ লেনদেন করলে তাঁর বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কুষ্টিয়ায় পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের নামে ১০ লাখ টাকার চেক গ্রহনের সময় শাকিল হোসেন নামে এক প্রতারককে গত সোমবার (২৪ জুন) সকালে কুষ্টিয়া পৌর অডিটোরিয়ামের সামনে থেকে আটক করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরে তাকে কুষ্টিয়া মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এসএম তানভীর আরাফাত প্রতিবেদক কে জানান, এক প্রতারক আমার আত্মীয় পরিচয়ে এক তরুণীর ভাইকে পুলিশে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ১০ লাখ টাকা দাবি করে। ওই তরুণী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে টাকার চেকসহ ওই যুবককে আটক করে।
তিনি জানান, এ ঘটনার পর থেকে চাকরি বাণিজ্যের দিবা স্বপ্নে যারা বিভোর ছিলেন তাঁরা সবাই সাবধান হয়ে গেছেন। কেউ প্রতারণার চেষ্টা করলেই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
মৌলভীবাজারে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম করে অর্থ লেনদেনের অভিযোগে পুলিশের এক উপ-পরিদর্শক (এসআই) শফিকুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত ও রনি নামে এক কনস্টেবলকে আটক করেছে পুলিশ। বুধবার (২৬ জুন) দুপুরে মৌলভীবাজার পুলিশ লাইন থেকে তাদের আটক করা হয়।
মৌলভীবাজার পুলিশ সুপার (এসপি) মো: শাহ জালাল জানান, যোগ্য প্রার্থীরাই পুলিশে চাকরি পাবেন। কোন তদবির বা সুপারিশে চাকরির সুযোগ নেই।
নিজেকে পুলিশ সদস্য পরিচয় দিয়ে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, লামাসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে চাকরি প্রার্থীদের পুলিশের কনস্টেবল পদে নিয়োগ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ৭ লাখ টাকা দাবির অভিযোগের প্রেক্ষিতে মারুফ (৩০) নামে এক যুবককে আটক করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) জাকির হোসেন মজুমদার জানান, মেধা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতেই পুলিশে নিয়োগ দেয়া হবে।
নাটোরে কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষার ইভেন্টে পাস না করেও পাস দেখিয়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তার স্বাক্ষর জালিয়াতি করার অভিযোগে শনিবার (২২ জুন) ৫ প্রার্থীকে আটক করেছে স্থানীয় পুলিশ।
আটকৃতরা হলেন- মেহেদী হাসান (২০), কামরুজ্জামান (১৯), আরিফুল ইসলাম (১৯), ইমন হোসেন (১৮) ও মাজেদুল ইসলাম (১৯)।
নাটোর জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুন জানান, আটককৃত ওই ৫ প্রাথী দীর্ঘ লাফে অংশ নিয়ে পাশ না করেও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে টোকেন জমা দেয়। টোকেন পরীক্ষার সময় বিষয়টি প্রমাণিত হলে তাদের আটক করা হয়।
চুয়াডাঙ্গায় কনস্টেবল নিয়োগে চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগে পুলিশ পরিদর্শক শহীদুজ্জামানসহ ৫ পুলিশ সদস্যকে ক্লোজড করা হয়েছে। রোববার (২৩ জুন) রাতে তাদের জেলা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে দুর্নীতি অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মাহবুবুর রহমান জানান, অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তাদের ক্লোজড করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিষয়টি অনুসন্ধানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আবুল বাশারকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
চট্টগ্রামে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার নামে অনৈতিক লেনদেনে জড়িত থাকার অভিযোগে গত শুক্রবার (২১ জুন) রাতে চিরঞ্জিব দাশ রঞ্জিব (৫৬) ও দুলাল আহম্মেদ (৫৫) নামে দুই প্রতারককে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুই প্রতারক নিজেদের পুলিশ সদস্য হিসেবেও পরিচয় দিতেন।
কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার জন্য ৯ লাখ টাকার চুক্তিতে একজনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নেওয়ার তথ্যের ভিত্তিতে তাদের গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
চুয়াডাঙ্গায় ভাতিজার চাকরির সুপারিশ করতে গিয়ে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন ঝিনাইদহের মহেশপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবদুল হাকিম। গত শনিবার (২২ জুন) তাকে বরখাস্ত করা হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে প্রতারণার অভিযোগে নগদ এক লাখ টাকাসহ আসাদুজ্জামান লিটন (৩৪) নামে এক প্রতারককে গত বৃহস্পতিবার (২০ জুন) আটক করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) টুটুল চক্রবর্তী প্রতিবেদক কে বলেন, কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির কোন সুযোগ নেই।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় পুলিশ সদস্য নিয়োগ পেলে সারাজীবন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সাথেই নিজের দায়িত্ব পালন করবে। এ লক্ষ্যেই সবাইকে সচেতন করতে আমরা ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছি।
দিনাজপুর জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ আবু সায়েম প্রতিবেদককে বলেন, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি মিলবে, মাননীয় আইজিপি মহোদয় আমাদের এ নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা এ নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়নে কাজ করছি।’